শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

বৃষ্টি খাতুনের ফ্যান্টাসি জগত

শরীফ আস্‌-সাবের: বিশ্বায়ন পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। বাজারভিত্তিক পৃথিবীতে আপামর মানুষ এখন অর্থ, সম্পদ, প্রাচুর্যের সোনার হরিণের পিছনে ছুটছে। এই অসদৃশ প্রতিযোগিতায় কেউ জয়ী হয়ে ভোগ করছে ঈর্ষণীয় রকমের বিলাসবহুল জীবন, আর কেউ এই জুয়া খেলায় হেরে গিয়ে মুখ থুবরে পড়ে যাচ্ছে পথের ধুলায়। বিশ্বায়ন মানুষের মন ও মননেও এনে দিয়েছে বিশাল পরিবর্তন। তথ্য প্রযুক্তি এবং মুঠো ফোনের বদৌলতে গোটা পৃথিবীই যেন চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। ‘রিয়েল টাইম কানেক্টিভিটি’র সুবাদে যে কোন তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, যুগপৎ ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে। এই যোগাযোগ বিপ্লবের বদৌলতে প্রায় সবাই এখন এক অস্বাভাবিক, ভার্চুয়াল বিশ্বের নাগরিক! জীবন এখন পণবন্দী তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক ধোঁয়াশা  কুহকে।

আর, এই বিশ্বায়ন সৃষ্ট চাকচিক্য, অতি উচ্চাভিলাষ, নিজের অসম সামাজিক অবস্থান এবং বন্ধু বান্ধবদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার অহেতুক প্রচেষ্টা থেকে জন্ম নেয় এক অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘Fantasy Prone Personality’ বা ‘ফ্যান্টাসি-প্রবণ ব্যক্তিত্ব’ (এফপিপি)। এই ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিরা জীবনভর গভীর অভিনিবেশ সহকারে অতি সক্রিয়ভাবে কল্পনাপ্রসূত এক স্বপ্নের জগত তৈরি করে তার মধ্যেই বসবাস করেন। এছাড়া, ধারণা করা হয়, ২.৫% প্রাপ্তবয়স্করা এক ধরনের দিবাস্বপ্ন দেখেন যাকে “ম্যালঅ্যাডাপ্টিভ দিবাস্বপ্ন” নামক একটি মানসিক ব্যাধি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এই ম্যালঅ্যাডাপ্টিভ দিবাস্বপ্নবাজরা প্রাণবন্ত কল্পনা এবং দিবাস্বপ্ন দেখার প্লট তৈরিতে খুব বেশি সক্রিয় থাকেন, যা তাদের দৈনন্দিন কাজ করার ক্ষমতাকে চরমভাবে ব্যাহত করে।

‘ম্যালএডাপ্টিভ দিবাস্বপ্ন’ সাধারণ দিবাস্বপ্ন থেকে আলাদা।

সাধারণ দিবাস্বপ্ন ক্ষণস্থায়ী এবং তা নিজস্ব কোনো স্বপ্নজগত সৃষ্টি করে না। একটি সমীক্ষা অনুসারে, এই সব অস্বাভাবিক দিবাস্বপ্নবাজরা তাদের জাগ্রত অবস্থার নিদেনপক্ষে অর্ধেক সময় কাটান তাদেরই ইচ্ছামাফিক তৈরি করা এক কল্পনার জগতে। তারা তখন নিজের অজান্তেই পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম এর জগতে প্রবেশ করেন, স্বপ্ন ও জাগরণের মধ্যে এক সেতুবন্ধ রচনার প্রয়াস চালান। অবচেতন মনে তারা তখন এমন সব চিত্রকল্প সৃষ্টির উদ্যোগ নেন, যা বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এবং যুক্তি-তর্ক বিবর্জিত।

বেইলী রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত বৃষ্টি খাতুনও কি এক ধরনের ম্যালএডাপ্টিভ দিবাস্বপ্নের শিকার হয়েছিলেন? অথবা, তিনি কি ছিলেন একজন ফ্যান্টাসি-প্রবণ ব্যক্তিত্ব? অবস্থাদৃষ্টে এমন সব সম্ভাবনা কোনক্রমেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জানা যায়, মাস ছয়েক আগে তিনি তাঁর নাম পরিবর্তন করে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নাম ধারণ করেন। আমাদের দেশের তরুণ তরুণীদের মধ্যে এই নাম পরিবর্তনের বিষয়টি বিরল নয়। অনেকেই তাদের পিতৃপ্রদত্ত নামকে সেকেলে মনে করেন এবং নিজেকে তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ কিংবা ‘স্মার্ট’ হিসেবে জাহির করার জন্য নিজের নাম পরিবর্তন করতেও পিছপা হন না। সিনেমা ও লেখালেখির জগতে বিচরণকারীদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। নাম ছাড়াও  বাবা-মার নির্দেশিত জীবনধারাকেও অনেকে পছন্দ করেন না। অনেকে পিতৃপরিচয় দিতেও দ্বিধা পোষণ করেন। আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মফস্বল থেকে আসা অনেক ছাত্র ছাত্রীকে রাতারাতি নিজেদের বদলে ফেলতে দেখেছি। টুপি পাঞ্জাবী থেকে জিন্স, জিন্স থেকে ড্রাগ আসক্তি এবং তারপর হারিয়ে যাওয়া কিংবা সন্ত্রাসী বনে যাওয়ার অনেক ঘটনাই প্রত্যক্ষ করেছি। মনে পড়ে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মানুষ ছিল ফুটবল পাগল। ঐ সময়ে মফস্বল থেকে ঢাকায় আসা আমাদের কিছু বন্ধু বান্ধব ছিলেন, যারা খেলা দেখতেন না, তেমন বুঝতেনও না, কিন্তু ‘আধুনিক’ হিসাবে পরিচিত বিশেষ দু’টি দলকে সাপোর্ট করতেন। অনেকেই কার্ল মার্কস কে ছিলেন তা না জেনেও  নিজেদের মার্কসবাদী বলে দাবি করতেন। এদের অনেকেই অবশ্য অকপটে শিকার করতেন, ‘গা থেকে গ্রামের গন্ধটা মুছে ফেলা দরকার, তা না হলে তো স্মার্ট হওয়া যাবে না’! না বুঝে বিশেষ কোন ফুটবল দলের সাপোর্টার হওয়া কিংবা ভুয়া  মার্ক্সিস্ট  বনে যাওয়ার মধ্যেই স্মার্টনেস নিহিত বলে তারা মনে করতেন। তাদের বাহ্যিক আচার আচরণে  হীনমন্যতাবোধ বেশ স্পষ্টভাবে ধরা পড়লেও তারা তা ঠিক ঠাহর করতে পারতেন না।  মফস্বলের ছেলে হিসেবে আমার ও আমার মত অনেকের কাছেই  এই জাতীয় বিষয়গুলো খটকা লাগতো।

সময় পাল্টেছে। পরিবর্তনের উতল হাওয়ায় সারা বিশ্ব যখন টালমাটাল, বাংলাদেশের মানুষ তখন ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেটপ্রেমী হয়েছে; মোবাইল ফোন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া পাল্টে দিয়েছে মানুষের জীবনধারা। দেশ না ছেড়েও এখন বিদেশি সংস্কৃতি কিংবা অপসংস্কৃতির সংস্পর্শে আসছে মানুষ। অনেকেই অন্তর্জাল আর কল্পনায় ভর করে ইচ্ছাস্বাধীন তৈরি করছেন তাদের স্বপ্নের ইন্দ্রপুরী। এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো, যে কোনো সামাজিক পরিবর্তনে বিশ্বের যুবসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে, জীবন ও তার সম্ভাবনা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকায় নতুন প্রজন্ম খুব সহজেই শিকার হয় বিভ্রান্তির, পা বাড়ায় ভুল পথে। কখনো আবার নিজের সীমাবদ্ধতা ভুলে ‘সব পেয়েছি’র হাতছানিতে হয়ে উঠে স্বপ্নবাজ, চোখে আঁটে রঙিন চশমা, সৃষ্টি করে অবাস্তব এক নতুন পৃথিবী। এই প্রবণতা প্রবল আকার ধারণ করলে এদের কেউ কেউ তাদের আত্মপরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন এবং নিজেকে সামিল করেন তাদের ভালো লাগা জগতের প্রিয় কোনো চরিত্রের সাথে। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের এই সমস্যাকে করে তোলে আরো বেশি জটিল ও মোহময়।

সম্ভবতঃ বৃষ্টি খাতুন তাদেরই একজন। হয়তো তিনি ছিলেন এফপিপি এবং ম্যালঅ্যাডাপ্টিভ দিবাস্বপ্নে আক্রান্ত  মানসিক ব্যাধিগ্রস্থদের একজন । তাঁর পিতা মাতা, পাড়া প্রতিবেশী, ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যানসহ সকলের জবানীতে একথা সুষ্পষ্ট, তিনি কুষ্টিয়ার বৃষ্টি খাতুন। কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই তিনি নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন ভিন্ন এক ফ্রেমে। প্রথমতঃ তাঁর নামটি হয়ত তাঁর কাছে সেকেলে মনে হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ  দেশে বিদেশে নানাবিধ মুসলিম বিরোধী অপপ্রচার এবং উপমহাদেশে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও প্রতিপত্তি দেখে হয়তো বা তাঁর কাছে মনে হয়েছে, একটি হিন্দু নাম ধারণ করে নিজেকে কোনো ভাবে ভারতীয় হিসেবে জাহির করতে পারলে মন্দ কি? সম্ভবতঃ নিজের নাম পরিবর্তন ছিল তার এই দিবাস্বপ্ন পূরণেরই প্রথম ধাপ। বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায়, change of identity বা পরিচয় পরিবর্তন ফ্যান্টাসি-প্রবণ ব্যাক্তিত্বের একটি প্রধান উপসর্গ। এ এক অদ্ভুত, অস্বাভাবিক পথচলা।

এদিকে, বৃষ্টি খাতুনের বাবা শাবলুল আলম ও মা বিউটি বেগম সুস্পষ্টভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণসহ বৃষ্টিকে তাঁদের সন্তান হিসেবে দাবি করেছেন। তা ছাড়া, বৃষ্টির স্কুল বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সহপাঠী এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাঁর পরিচয় নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই বলে জানিয়েছেন। কোনো কারণ ছাড়াই পরিচয়ের বিভ্রম ছড়িয়ে বৃষ্টির মরদেহ নিয়ে তার পরিবারকে হেনস্থা করা হচ্ছে বলেও তাঁরা মনে করেন। এ প্রসঙ্গে  চ্যানেল ২৪-এ প্রচারিত একটি ভিডিও ফুটেজের প্রতি অনেকেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। ফুটেজটিতে দেখা যায়, রমনা কালী মন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহা বৃষ্টি খাতুনের শোকসন্তপ্ত বাবাকে জেরা করছেন। উৎপল সাহা জানান, তাঁর সাথে বৃষ্টির আট মাসের পরিচয় ছিল। তিনি দাবি করেন, বৃষ্টির মূল পরিবারের সবাই ভারতের বেনারসে থাকেন, যার সপক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।

সব মিলিয়ে বৃষ্টি খাতুনের আসল পরিচয়ের সপক্ষে সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং সাক্ষী সাবুদ থাকা সত্ত্বেও কেন তাঁর পরিচিতি নিয়ে ধোঁয়াশা, তা বোঝা দুষ্কর। আর, বৃষ্টির ডিএনএ টেস্টেরই বা কি প্রয়োজন ছিল? জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ এবং এসএসসি সার্টিফিকেট ছাড়াও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, বিদ্যালয়ের প্রধান, শিক্ষক, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব সবাই এক বাক্যে সাক্ষ্য দিচ্ছে, মৃত বৃষ্টি খাতুনের পরিচয় নিয়ে কোনো দ্বিধা দন্দ্ব নেই। এছাড়া, অন্য কেউ তাঁকে সন্তান বলেও দাবী করছেন না। শুধু মন্দিরে গিয়েছেন এবং নিজের নাম পরিবর্তন করতে চেয়েছেন, সেই অজুহাতে সন্দেহ সৃষ্টি হলেও সকল সাক্ষ্য প্রমাণ এই সন্দেহকে ইতোমধ্যেই ভিত্তিহীন প্রমাণ করেছে। তার পরও তার লাশ তাঁর শোকবিহ্বল পিতামাতার কাছে হস্তান্তরের দীর্ঘসূত্রিতা দুখঃজনক ও হৃদয়বিদারক।  

যাইহোক, এফপিপি এবং ম্যালঅ্যাডাপ্টিভ দিবাস্বপ্ন দু’টিই সিরিয়াস মানসিক ব্যাধি যার উপর বিশ্বব্যাপী  প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে এই রোগের প্রকোপও বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের যুবসমাজও এর প্রভাবমুক্ত নয়। তবে, প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, বাংলাদেশে এই ধরনের মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব কতটুকু এবং এর মূল কারণগুলো কি কি ? এই রোগে আক্রান্তদের সংখ্যাই বা কত? এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশের মনোবিজ্ঞানীদের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠাও স্বাভাবিক। হয়তো বা, দেশের মনোবিজ্ঞানীরা যথাসময়ে  বৃষ্টি খাতুন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে তুলে আনলে  তাঁর পরিচয় বিভ্রাটের সুরাহা সহজ এবং দ্রুততর হতো এবং তাঁর অসহায় মা বাবাকে দিনের পর দিন সন্তানের লাশের অপেক্ষায় কষ্টের প্রহর গুণতে হতো না! এই বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি, রোগ নির্ণয় এবং  প্রয়োজনীয় মানসিক চিকিৎসার লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের এখনই সময়, যা ভবিষ্যতে এই ধরনের সমস্যার দ্রুত এবং সুষ্ঠু সমাধান অর্জনে সহায়তা করবে। নয়া দিগন্ত অনলাইন থেকে।

আরো পড়ুন ...