বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
অবশেষে অপেক্ষার অবসান। ভাসতে ভাসতে চাঁদে পৌঁছাল ল্যান্ডার বিক্রম। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদের মাটি ছুঁয়ে জানান দিল ভারতীয় বিজ্ঞানের অগ্রগতির বিশালতা।
গত ১৪ জুলাই ঠিক দুপুর ২ট ৩৫ মিনিট। ইতিহাস গড়ার পথে প্রথম পা বাড়িয়েছিল চন্দ্রযান-৩। শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে চাঁদের উদ্দেশে উড়ে গিয়েছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর এই মহাকাশযান। দিনরাত এক করে, খাওয়া-ঘুম ছেড়ে একে একে ৪০ দিন কাটিয়েছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। নজর রাখেছিলেন চন্দ্রযান-৩-এর গতিবিধির ওপর। ইতিহাস তৈরির মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী থাকবেন বলে অপেক্ষায় ভারতবাসী । অবশেষে অবসান হল সেই অপেক্ষার। ভাসতে ভাসতে চাঁদের বুকে পা রাখলো চন্দ্রযান-৩–এর ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদের মাটি ছুঁয়ে ইতিহাস গড়ল ভারত।
চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্যের পর ভারত জুড়ে উৎসবের আমেজ। আবেগে ভাসছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। তৃতীয় বিশ্বের দেশের চোখ টাটিয়ে দেওয়া সাফল্যে শুভেচ্ছা বার্তা আসছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলি থেকেও।
২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২-এর ব্যর্থতার পর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় ইসরোর চাঁদের মাটি ছোঁয়ার স্বপ্ন। কান্নায় ভেঙে পড়েন ইসরোর সাবেক চেয়ারম্যান কে শিবন। কিন্তু দমে যাননি তারা। নেমে পড়েন চন্দ্রযান-৩-এর কাজে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে চাঁদের মাটি ছোঁয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ইতিহাস তৈরির লক্ষ্যে নতুন করে পথ চলা শুরু করে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে ইসরো এই প্রকল্পটি শুরুর জন্য কেন্দ্রের কাছে প্রাথমিক ভাবে ৭৫ কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়েছিলে ইসরো। যার মধ্যে ৬০ কোটি অত্যাধুনিক সরঞ্জাম এবং অন্যান্য ব্যয় মেটানোর জন্য এবং বাকি ১৫ কোটি রাজস্ব ব্যয়ের জন্য চাওয়া হয়। টাকা পেয়ে কাজ শুরু করে ইসরো।
চন্দ্রযান-১ এবং চন্দ্রযান-২-এর মতোই চন্দ্রযান-৩ খুব ব্যয়বহুল অভিযান ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া চাঁদের অভিযানে যে অর্থ খরচ করে, তার তুলনায় অনেক কম। চন্দ্রযান-৩-এর বাজেট ছিল ৬১৫ কোটি টাকা। সাড়ে তিন বছর পরিশ্রমের পর ইসরোর ঘোষণা দেয় ১৪ জুলাই চাঁদের দেশে পাড়ি দেবে চন্দ্রযান-৩।
ঘোষণা অনুযায়ী ১৪ জুলাই চন্দ্রযান-৩ শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে যাত্রা শুরু করে। ইসরোর এই চন্দ্রযানের কেন্দ্রে ছিল এলভিএম-৩ রকেট। যা চন্দ্রযানটিকে শক্তি জুগিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে ঠেলে দিয়েছিল। এলভিএম-৩ একটি ত্রিস্তরীয় উৎক্ষেপণ যান। এর আগে একাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ এবং চন্দ্রযাত্রায় এই এলভিএম-৩ ব্যবহৃত হয়েছে। একে ভারতীয় রকেটের ‘বাহুবলী’ বলা হয়।
১৫ জুলাই পৃথিবীর প্রথম কক্ষপথ পেরিয়েছিল চন্দ্রযান-৩। উৎক্ষেপণের পর চাঁদের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দ্বিতীয় বার যানটি কক্ষপথ পরিবর্তন করে ১৭ জুলাই। ১৮ জুলাই, ২০ জুলাই এবং ২৫ জুলাই পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের গণ্ডি ছাড়িয়ে তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম কক্ষপথ অতিক্রম করে চন্দ্রযান ৩। ৩১ জুলাই পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে নিজের গতি বাড়িয়ে চাঁদের কক্ষের উদ্দেশে পাড়ি দেয় চন্দ্রযান-৩। অর্থাৎ, উৎক্ষেপণের ১৭ দিনের মাথায় পৃথিবীর সমস্ত টান কাটিয়ে বেরিয়ে যায় মহাকাশযানটি।
চন্দ্রযান-৩ চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে ৫ আগস্ট। ৩১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট অর্থাৎ, পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশের মাঝের এই ছয়দিন উৎকণ্ঠায় কেটেছিল ইসরোর বিজ্ঞানীদের।
ইসরোর বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ছিল, অঙ্কের সামান্য ভুলে যদি চন্দ্রযান-৩ শেষ পর্যন্ত চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছতে না পারে, তবে তা আবার ঘুরে চলে আসবে পৃথিবীর কক্ষপথে। কিন্তু সেখান থেকে তাকে আবার চাঁদে পাঠানোর মতো জ্বালানি আর থাকবে না। সে ক্ষেত্রে চন্দ্রযান-৩কে ‘লস্ট মিশন’ বা ব্যর্থ অভিযান বলেই ধরে নেওয়া হবে। তবে তা হয়নি। বিনা বাঁধায় চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে চন্দ্রযান-৩। এর পর ধীরে ধীরে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহের দিকে এগিয়ে চলে মহাকাশযানটি। চাঁদের চারদিকে পাক খেতে খেতে ক্রমশ গতি কমাতে থাকে চন্দ্রযান-৩।
৫ আগস্ট থেকে ১৬ অগস্ট পর্যন্ত চন্দ্রযান-৩ একটি একটি করে চাঁদের কক্ষপথ নির্বিঘ্নে পেরোতে থাকে। এর মধ্যেই ৬ আগস্ট বাইরের দিক থেকে চাঁদের দ্বিতীয় কক্ষপথে প্রবেশ করে গন্তব্যের ছবি তুলে ফেলেছিল চন্দ্রযান-৩। ১৭ আগস্ট চাঁদের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় চন্দ্রযান-৩। মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিকভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় ১৭ আগস্টেই। রোভার প্রজ্ঞানকে পেটে নিয়ে ধীরে ধীরে চাঁদের দিকে নামতে শুরু করে ল্যান্ডারটি। প্রাথমিকভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে অবস্থান করছিল বিক্রম।
এর পর চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দুর্গম খানাখন্দে ভরা মাটিতে অপেক্ষাকৃত মসৃণ জমি খোঁজার কাজ শুরু করে বিক্রম। সেই জমি খুঁজে পেতেই পেরিয়ে যায় কয়েকটি দিন। এর মাঝে চন্দ্রপৃষ্ঠের একের পর এক ছবি তুলে ইসরোতে পাঠাতে থাকে চন্দ্রযান-৩।
ভাসতে ভাসতেই অবতরণের উপযুক্ত জমি খুঁজে পেয়েছিল ল্যান্ডার বিক্রম। ২৩ অগস্ট রোভার প্রজ্ঞানকে পেটের ভিতরে নিয়ে সেখানেই ‘পাখির পালকের মতো অবতরণ’ (সফ্ট ল্যান্ডিং) শুরু করে। চার বছর আগে ঠিক যে পর্যায়ে এসে ব্যর্থ হয়েছিল ইসরোর ‘চন্দ্রযান-২’। কিন্তু চন্দ্রযান-৩ বিফলে গেল না।
ইসরোর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিট নাগাদ চাঁদের মাটিতে নেমে ইতিহাস তৈরি করল ভারতের চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার।
সূত্র: আনন্দবাজার।