বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে

মানব জমিন প্রতিবেদন।।

নাম নামিরা। রাজধানীর নামকরা একটি কলেজের শিক্ষার্থী। একই কলেজের সহপাঠীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চলে বেশকিছু দিন। এক সময় প্রেমে ফাটল ধরে। বাবা গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। অর্থ-বিত্তের মাঝে বড় হয়েছেন। প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে হতাশ হয়ে পড়েন নামিরা। এ সময় তার সহযোগী হন আরেক বন্ধু রায়হান। হতাশা থেকে ফিরে আসতে রায়হান মাদক তুলে দেন নামিরার হাতে। একদিন-দু’দিন করতে করতে মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে যান নামিরা।

এখন রায়হান নামিরার বাসায় পৌঁছে দেন মাদক। বিনিময়ে রায়হান পান অর্থ। এক সময় নামিরার পরিবার বিষয়টি জানতে পেরে একটি বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা করায়।

সামিয়া আক্তার এবং সাদিক দম্পতি। সামিয়া রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর বিয়ে হয়ে যায়। সাদিক পেশায় ব্যবসায়ী। বিভিন্ন সময় ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে নেশার জগতে জড়িয়ে পড়েন সাদিক। ধূমপান দিয়ে শুরু হলেও পরর্তীতে ইয়াবা, গাঁজা, মদ্যপানসহ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হন। এক সময় বাসার বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে নেশা করলেও পরবর্তীতে বাসায় বসে নেশা শুরু করেন। পরে নেশার পার্টনার হিসেবে স্ত্রীকে যুক্ত করেন। এক সময় দু’জনই মাদকাসক্ত হয়ে ওঠেন।  নিয়মিত মাদক না নিতে পারলে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তাদের মাদক সেবনের বিষয়টি সামনে আসে। 

মুনিরা। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। রংপুর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং করতে ঢাকায় আসেন। রাজাবাজারের একটি মেসবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন। বন্ধুদের সঙ্গে গভীররাত পর্যন্ত আড্ডা দেন। শহুরে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে প্রথমে সিগারেট পরবর্তীতে বন্ধুদের সঙ্গ দিতে গিয়ে আইস, শিসা ও ইয়াবায় আসক্ত হন। রাতের ঢাকায় বনানীসহ বিভিন্ন এলাকার শিসাবারে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। এক পর্যায়ে পড়াশোনায় অনিয়মিত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে শুরু করেন। নেশার টাকা যোগাতে পরিবারের কাছে মিথ্যা কথা বলে টাকা নেয়া, বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পান্থপথের একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। সেখানে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হয়ে পুনরায় মাদকে জড়ান এই শিক্ষার্থী। 

মাদক গ্রহণে বাধা দেয়ায় এর আগে রাজধানীর চালেমীবাগের একটি বাসায় পুলিশের বিশেষ শাখার এক কর্মকর্তা এবং তার স্ত্রীকে হত্যা করে তাদেরই কিশোরী মেয়ে ঐশী। যেটা নিয়ে তখন সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। পূলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশে ২৪ ধরনের মাদক থাকলেও মাদকসেবীরা ৬ থেকে ১০ ধরনের মাদক সেবন করছে। ‘গ্যাং কালচার’ কিশোর-তরুণ, পথশিশু, হতাশাগ্রস্ত বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনো ভাবে মাদক গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত বছরের তথ্য বলছে, শতকরা ৪৪ ভাগ পথশিশু মাদক চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে ৫ লাখ শিশু মাদকাসক্ত এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ শিশু মাদক গ্রহণের খরচ মেটাতে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে নারী মাদকসেবীর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ঢাকা আহছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬৪৭ জন নারীকে চিকিৎসা দিয়েছে। তাদের মধ্যে ১২৯ জন পুনরায় চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এসব নারীর মধ্যে ৩৩ শতাংশ ইয়াবা, ২৮ শতাংশ গাঁজা, ১৬ শতাংশ ঘুমের ওষুধ, ১৫ শতাংশ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের মাদক, ২ শতাংশ মদ, ২ শতাংশ শিরায় মাদক নিয়েছেন। যাদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া ৩৪ শতাংশ, মুড ডিজঅর্ডার ৩০ শতাংশ, বাইপোলার ১২ শতাংশ, ডিপ্রেশন ১০ শতাংশ, ওসিডি ৬ শতাংশ ও বাকিরা অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত।

বন্ধুদের চাপ, একাকিত্ব, পরিবারের অন্য সদস্য বা বন্ধুবান্ধবের মাদক গ্রহণ, বিষণ্নতা, হতাশা, বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা শাসন, অভিভাবকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, বিচ্ছেদ, সন্তানকে সময় না দেয়ার প্রবণতা- এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের হিসাবে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ এবং সবচেয়ে বেশি মাদক ব্যবহারকারী ঢাকা বিভাগে। যদিও বেসরকারি হিসাবে, মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ লাখের কাছাকাছি বলে দাবি বিভিন্ন সংস্থার।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক (রেজিস্ট্রার) রাইসুল ইসলাম পরাগ মানবজমিনকে বলেন, পুরুষের তুলনায় খুব কমসংখ্যক মাদকাসক্ত নারী চিকিৎসা নিতে আসেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় প্রেমিক- প্রেমিকা, শিক্ষার্থী, স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। 
মুক্তি মানসিক হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও মাদকাসক্ত বিশেষজ্ঞ ডা. আলী আসকার  কোরেশী বলেন, বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা অনেকটাই বেড়েছে। বন্ধু, প্রতিবেশী, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি থেকে মাদক গ্রহণ করে থাকে নারীরা। গণমাধ্যমে মাদকের কুফল নিয়ে অনেক বেশি প্রচার- প্রচারণা, স্কুল-কলেজে বিভিন্ন সময়ে মাদকবিরোধী সেমিনারের আয়োজন করা, সন্তানের প্রতি বাবা-মা’র নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখার মাধ্যমে নারীদের মাদকে আসক্তির ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ।

আরো পড়ুন ...