সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

কক্সবাজার সৈকতে মরা জেলিফিশ–কাছিম ভেসে আসার কারণ কি?

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে কয়েক দিন ধরে ভেসে আসছে অসংখ্য মরা জেলিফিশ। এর পাশাপাশি ডলফিন ও কাছিমের মৃতদেহও ভেসে আসছে। ডলফিন ও কাছিমগুলোর শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে। মৎস্য ও পরিবেশবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে কিংবা অন্য কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রাণীগুলোর মৃত্যু হচ্ছে বলে তাঁদের ধারণা। কিন্তু গভীর সমুদ্রে গিয়ে এর প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটনের কেউ নেই।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে জোয়ারে ভেসে আসে দুটি মৃত ডলফিন। কিছুক্ষণ পর একটি জোয়ারের পানিতে পুনরায় সমুদ্রের দিকে ভেসে যায়। আরেকটি বালুচরে আটকে থাকে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় বাংলাদেশ সমুদ্র মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৎস্যবিশেষজ্ঞ দল। তারা সৈকতে পড়ে থাকা ডলফিনটির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে।

বাংলাদেশ সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের মহাপরিচালক ও মৎস্যবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, সৈকতে ভেসে আসা ৩ ফুট লম্বা মৃত ডলফিনটির ওজন প্রায় ১৫ কেজি। ডলফিনটির শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। দেহে পচন ধরেছে। সে জন্য ধারণা করা হচ্ছে, এটি কয়েক দিন আগে মারা গেছে। এটি ইরাবতী প্রজাতির ডলফিন। জেলেদের জালে আটকা পড়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে আঘাত পেয়ে এটির মৃত্যু হতে পারে।

মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলেন, ইরাবতী ডলফিন সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি, নদীর সঙ্গে সংযোগস্থলে স্বাদু ও লোনাপানির মিশ্রণ আছে, এমন এলাকায় বসবাস করে। উপকূলের কাছাকাছি এসব জায়গায় জেলেদের জাল থাকে। বিশেষ করে গিল নেট ও টানা জালে ইরাবতী ডলফিন আটকে পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে।

ডলফিন রক্ষায় গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে মৎস্যবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, পাশাপাশি ডলফিনের আবাসস্থল চিহ্নিত করা, বিচরণ নিরাপদ করা এবং নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও অভিযান পরিচালনা জরুরি।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, কয়েক দিন ধরে কলাতলী, দরিয়ানগর ও হিমছড়ি সৈকতে বিপুল পরিমাণে মরা জেলিফিশ ভেসে আসছে। এ সময় দুটি মরা কাছিমও ভেসে আসে। এর আগে ২০২২ সালের আগস্ট ও নভেম্বরে তিন দফায় কয়েক হাজার মরা জেলিফিশ সৈকতে ভেসে এসেছিল। তখন ১০-১৫টি মরা কাছিম ও ২টি ডলফিন ভেসে এসেছিল। কিন্তু এর কারণ অনুসন্ধানে কোনো সময় উদ্যোগ কিংবা গবেষণা হয়নি।

দেখা গেছে, গত বুধবার সন্ধ্যায় কলাতলী সৈকতে জোয়ারের পানিতে একসঙ্গে ভেসে আসে কয়েক হাজার মরা জেলিফিশ। বৃহস্পতিবার সকালেও বেশ কিছু জেলিফিশ ভেসে আসে। অধিকাংশ জেলিফিশ বালুতে চাপা পড়েছে। কিছু জেলিফিশ জোয়ারের পানিতে পুনরায় ভেসে গেছে। এখনো কিছু জেলিফিশ সৈকতে পড়ে আছে।

লাইফগার্ড হিসেবে সৈকতে কাজ করা জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ জোয়ারের পানিতে কয়েক হাজার জেলিফিশ ভেসে আসার ঘটনায় সবাই হতবাক হয়েছেন। এগুলোর ওজন ৩ থেকে ১৮ কেজি পর্যন্ত।

জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা জেলিফিশ, কাছিম নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়েছেন সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৎস্যবিজ্ঞানীরা। গবেষণাকেন্দ্রটির মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, আঘাতে মা কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মরা কয়েকটি কাছিমের শরীরেও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। তবে এ সময়ে (গত বুধ ও বৃহস্পতিবার) বিপুল পরিমাণ জেলিফিশের মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। ধারণা করা হচ্ছে, ডলফিন-কাছিমের মতো জেলিফিশও মাছ ধরার জালে আটকে মারা যেতে পারে। জেলেরা মরা জেলিফিশ সাগরে নিক্ষেপ করেন। পরবর্তীকালে জোয়ারের পানিতে মরা জেলিফিশগুলো সৈকতে ভেসে আসছে।

গত বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরেও তিন দফায় কয়েক হাজার জেলিফিশ সৈকতে ভেসে এসেছিল। এ নিয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও রহস্য উদ্‌ঘাটনে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলেন, সমুদ্রে একাধিক প্রজাতির জেলিফিশ আছে। ভেসে আসা জেলিফিশগুলো বক্স প্রজাতির। নামের সঙ্গে ফিশ থাকলেও জেলিফিশ আসলে মাছ নয়।

শহরের দরিয়ানগর এলাকার জেলে সাব্বির আলম (৪৫) বলেন, সাগরে ইলিশ ধরার জাল ফেললেই ২০-৩০টি করে জেলিফিশ জালে আটকা পড়ে। জেলেরা ইলিশসহ অন্যান্য মাছ জাল থেকে বেছে নিলেও জেলিফিশগুলো সাগরে ফেলে দেন। জোয়ারের পানিতে সেই জেলিফিশ সৈকতে ভেসে আসছে। স্থানীয় ভাষায় জেলিফিশকে বলে ‘নুইন্যা’। সমুদ্রের অল্প পরিমাণ পানিতেও জেলিফিশ ভাসতে দেখা যায়। এগুলো মানুষের শরীরে স্পর্শ করলে চুলকানি হয়, কিছুক্ষণ শরীর অবশ হয়ে পড়ে। এ কারণে মানুষ জেলিফিশের ধারেকাছেও যান না।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বেদারুজ্জামান বলেন, সাগরে মাছ ধরার ট্রলারের জালে আটকা পড়েই বেশির ভাগ জেলিফিশের মৃত্যু হচ্ছে। এ ছাড়া জেলিফিশের আয়ুষ্কালও কম—মাত্র এক থেকে তিন বছর। আয়ুষ্কাল শেষ হলে জেলিফিশের মৃত্যু হতে পারে।

কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, এখন সাগরে পাঁচ হাজারের বেশি ট্রলার ইলিশ ধরছে। প্রতিদিন ২০০-৩০০ ট্রলার শহরের ফিসারিঘাটসহ জেলার টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও চকরিয়ার বিভিন্ন ঘাটে ফিরছে। কোনো ট্রলারের জালে জেলিফিশ, ডলফিন, কাছিম আটকা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে গভীর সাগরে বিদেশি জাহাজের জালে আটকা পড়ে জেলিফিশ, ডলফিন, কাছিম মারা যাওয়ার অভিযোগ আছে বলে জানান তিনি। প্রথম আলো

আরো পড়ুন ...