মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ডায়াবেটিক রোগীর জন্য রোজা রাখা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় ১৪-১৫ ঘণ্টা রোজা পালন করতে হবে এবছর এবং সময়টাও বসন্ত ও গ্রীষ্মের সংমিশ্রণ। তাই বাড়তি কিছু সতর্কতা অবলম্বনও জরুরী
একজন ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখতে গিয়ে যে বিশেষ ঝুঁকিগুলোর সম্মুখীন হন, সেগুলি হলো, হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া), হাইপারগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাওয়া), ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস (গ্লুকোজ অতি মাত্রায় বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিসের জরুরি অবস্থা), পানিশূন্যতা ও রক্তে জমাট বাধার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া। এই পরিস্থিতিগুলোর সম্মুখীন না হয়ে কিভাবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে রমযানের সবগুলো রোজা রাখা যায় তা নিয়ে রোগীদের মনে কিছু প্রশ্ন আসে।
যেমন- তিনি রোজা রাখতে পারবেন কিনা? খাদ্যাভাস কেমন হবে? রমজানের চিকিৎসা ব্যাবস্থা কেমন থাকবে? হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে কি করবেন? রোজা রেখে রক্ত পরীক্ষা করা যাবে কি না? কোন কোন সময় রক্ত পরীক্ষা করা যাবে? রোজা রেখে ইনসুলিন দেয়া যাবে কিনা? ইত্যাদি।
একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব এক্ষেত্রে বহুগুণ বেশি, কারণ রোগীর একটি ফরয কাজ একজন চিকিৎসকের বিচক্ষণতা ও সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। তাই চিকিৎসকের মনে রোগীর চাইতেও অনেক বেশি প্রশ্নের উদয় হয়। যেমন- প্রথমত, ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য রোজা রাখা কতটা নিরাপদ। দ্বিতীয়ত, একজন টাইপ ১ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিক রোগী কিভাবে রোজা রাখবেন। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের রোগীর জন্য রোজা রাখা আদৌ কতটুকু নিরাপদ। তৃতীয়ত কাদের জন্য রোজা খুব ঝুঁকিপূর্ণ, কোন ধরনের ওষুধ নিরাপদ, ইনসুলিন নেওয়া যাবে কিনা বা নিলে কি মাত্রায় নিতে হবে ইত্যাদি।
ইসলাম সহজ ও শান্তির ধর্ম। আল্লাহ আমাদের কাজগুলো সহজ করে দেন এবং জটিলতা কামনা করেন না। চিকিৎসক যদি রোগীকে রোজা রাখতে নিষেধ করেন, তবে ধরে নিতে হবে, রোজাপালন সেই রোগীর জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ডায়াবেটিক রোগী যাদের রোজা পালন আবশ্যক নয় তারা হলেন- অপ্রাপ্তবয়ষ্ক, মানসিক ভারসাম্যহীন, অতিবৃদ্ধ, দুর্বল এবং হঠাৎ গুরুতরভাবে অসুস্থ ব্যাক্তি, দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ, ডায়াবেটিসের জটিলতাজনিত অসুস্থতা, ৫০ মাইলের অধিক দূরত্ব ভ্রমণকারী, মাসিক চলাকালীন সময়ে স্ত্রীলোক, গর্ভবতী ও দুগদ্ধদানকারিণী স্ত্রীলোক।
একজন ডায়াবেটিক রোগীর ডায়াবেটিসের ধরন, কতদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছেন, হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে বুঝতে পারেন কিনা, ডায়াবেটিস এর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা আছে কিনা, নিজেই নিজের ডায়াবেটিস মাপতে পারেন কিনা, ডায়াবেটিসের ৩ মাসের গড়, তিনি গর্ভবতী কিনা, দৈনিক কি ধরনের শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়, রমজানে রোজার সময়কাল কতটুকু এবং তিনি কি ধরনের ওষুধ গ্রহণ করছেন, তার উপর ভিত্তি করে ডায়াবেটিস রোগীর ৩ ধরনের ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারন করা হয়।
ঝুঁকিশ্রেণি ১: উচ্চ ঝুঁকিতে যারা, তাদের রোজা রাখা উচিত নয়। ঝুঁকিশ্রেণি ২: মধ্যম ঝুঁকিতে যারা, তাদের রোজা রাখা বা না রাখা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। ঝুঁকিশ্রেণি ৩ : যাদের রোজা রাখা কিছুটা নিরাপদ।
দেখা যাচ্ছে সবারই কিছু না কিছু ঝুঁকি আছে। তবে তার মানে এই নয় যে, তিনি রোজা রাখতেই পারবেন না। বরং ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী রোজা রাখা বা না রাখা নির্ভর করে। একজন রোগী উপরিউক্ত ঝুঁকি মাত্রা জেনেও ধর্মীয় আগ্রহের কারণে যদি রোজা রাখার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করেন, তবে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের ভূমিকা হবে তাকে ঝুঁকিগুলো অবহিত করে, যতটা সম্ভব ঝুঁকি কমিয়ে নিরাপদ রোজা রাখতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা।
খাদ্য ব্যবস্থাঃ প্রতিদিনের খাবারকে ৩ ভাগে ভাগ করবেন, ইফতার, সন্ধ্যারাত ও সেহেরী। রোজার আগে সারাদিনে যত ক্যালরি খাবার খেতেন, রোজাতেও তাই থাকবে, যা ডায়াবেটিসের গাইড বইটিতে প্রতিটি রোগীর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। সারাদিনের বরাদ্দ খাবারের ৪০ থেকে ৫০ ভাগ খাবেন ইফতারে, ৩০ থেকে ৪০ ভাগ খাবেন সেহরিতে আর ইফতার বা তারাবির পরে হালকা খাবার খাবে, যা ১০ থেকে ২০ ভাগ।
ইফতারে চিনিমুক্ত শরবত খাবেন। আজানের অল্প আগে বা আজান দেয়ার সাথে সাথে ইনসুলিন নিয়ে খাবার খেয়ে নামাজে যাবে। স্বাভাবিক সময়ে সকালে যে ওষুধ বা ইনসুলিন নিতেন, রমজানে তা ইফতারে নিবেন। প্রথম দিকে সতর্কতা বসত ২ বা ৪ ইউনিট কমিয়ে নিতে পারেন। পরের রোজাগুলোতে গ্লুকোজ মেপে মাত্রা ঠিক করে নিতে পারেন। খেজুর খেতে পারবেন, তবে একটা বা দুটোর বেশি নয়।
অতিরিক্ত শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাবার বর্জন করতে হবে। ইফতারে মিষ্টি জাতীয় খাবার- যেমন: জিলাপী, লাড্ডু, বরফি, মিষ্টি, চিনিযুক্ত শরবত পরিহার করুন, প্রচুর ডাবের পানি পান করুন। ভাজা খাবার- যেমন- সমুচা, পাকোড়া, পুরি, পরটা, কাবাব, যতটা সম্ভব কম খাবেন। প্রচুর পরিমানে পানি পান করুন, সালাদ ও সবুজ সব্জি বেশি করে খান। সন্ধ্যা রাতের খাবার একেবারেই বাদ দেয়া ঠিক না। অন্নান্য সময়ের রাতের খাবারের সমপরিমাণ খাবার খেতে হয়। কম খেলে ইনসুলিন বা ট্যাবলেটের মাত্রা ও খুব কমিয়ে দিতে হবে। সেহেরির খাবার কখনোই বাদ দেয়া যাবে না। সেহেরীতে অধিক আঁশযুক্ত খাবার, লাল আটা, লাল চাল, শাকসবজি ও ফল খাবেন। সেহেরীতে খেতে হবে অন্নান্য দিনের দুপুরের খাবারের সমপরিমাণ এবং সেহেরীর শেষ সময়ের অল্প আগে খাবার গ্রহণ করুন। স্বাভাবিক সময়ে রাতে যে পরিমাণ ইনসুলিন বা ট্যাবলেট নিতেন, রোজায় সেহেরিতে তার অর্ধেক নিবেন। তবে এই চিকিৎসাগুলো আপনার চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিয়ে তবেই শুরু করুন। কারণ ডায়াবেটিসের বর্তমান মাত্রা অনুযায়ী, ওষুধের ডোজের তারতম্য হতে পারে। ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত প্রচুর পানি পান করুন। বর্তমানে ডায়াবেটিসের অনেক আধুনিক চিকিৎসা আছে, যেমন দিনে ১ বার ইনসুলিন দেয়া, বা সপ্তাহে ১ বার একটি ইনজেকশনের মাধ্যমেও ডায়াবেটিসের চিকিৎসা সম্ভব এবং এ ধরনের ওষুধে অনান্য সুবিধার পাশাপাশি হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকিও কম থাকে। আমাদের দেশেও এই ওষুধগুলো পাওয়া যায়। কাজেই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এই ওষুধগুলোও গ্রহণ করতে পারেন। যারা হাইপোথাইরয়েডিসমের ওষুধ খান, তারাও তা সেহেরির আগে খেয়ে নিতে পারেন, বা ইফতারের ৪ ঘণ্টা পর।
মোট খাবারের ৪৫-৫০% শর্করা, ২০-৩০% প্রোটিন, ৩৫% এরও কম ফ্যাট, বিশেষ করে মনো-আনস্যাচুরেটেড বা পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড ভালো। কাজেই রান্না বা ভাজার তেলে এ সময় অলিভ ওয়েল ব্যবহার করা উত্তম।
ব্যয়ামঃ বাসায় স্বাভাবিক হাঁটা চলা করবেন। তবে অতিরিক্ত ব্যয়ামে বিশেষ করে ইফতারের আগে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি ব্যয়াম করতেই চান, তবে তা ইফতারের ১ বা ২ ঘণ্টা পরে করা যেতে পারে। রোজা থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম পরিহার করুন, বিশেষ করে ইফতারের পূর্বে। তারাবীহ্ এর নামাজ পালনের মাধ্যমেও ব্যায়ামের উদ্দেশ্য কিছুটা পূরণ হয়।
রোজা রেখে রক্ত পরীক্ষা করা যাবে কিনা, ইনসুলিন নেয়া যাবে কিনা এ নিয়ে অনেকের মনেই সংশয়। রোজা রেখে রক্ত পরীক্ষা ও ইনসুলিন দেওয়া যাবে। এতে রোজার কোন ক্ষতি হয়না, এ বিষয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক ইসলামি সংগঠনের সমর্থন আছে। রক্তের গ্লুকোজ মাপবেন ইফতারের ৩০ মিনিট পূর্বে, ইফতারের ২ ঘণ্টা পর, সেহরির আগে ও ২ ঘণ্টা পর, মধ্য দুপুর ১২টায়, অন্য যে কোনো সময় রোগী যদি গ্লুকোজ কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়ার লক্ষণগুলো দেখেন বা শারীরিকভাবে অস্বস্তিবোধ করেন।
কখন রোজা ভাঙতে হবে? রক্তের গ্লুকোজ ৩.৯ বা তার নিচে থাকলে, দিনের যেকোনো সময় গ্লুকোজের মাত্রা ১৬.৭ মিঃমোল/লিঃ বা এর বেশি হলে সাথে সাথে প্রস্রাবের কিটোন বডি দেখতে হবে, এছাড়া অন্য কোন মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে, সাথে সাথে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। যদি ডায়াবেটিস ৩.৯-৫.০ মিলি মোল/ লিঃ থাকে তবে ১ ঘন্টা পর পুনরায় মেপে দেখতে হবে, প্রয়োজনে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে।
গর্ভাবস্থায় রোজা : গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না হলে বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, তাই রোজা না রাখাই ভালো। এই রোজাগুলোর জন্য ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী যা করণীয়, তা করে নিবেন। তবে বাধা সত্বেও, ঝুঁকি নিয়ে কেউ যদি রোজা রাখতে চান, তাকে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। তবে তার ক্ষেত্রেও যদি উল্লেখিত মাত্রায় ডায়াবেটিস কমে যায়, বা তিনি যদি রোজা রাখা অবস্থায় বাচ্চার নড়াচড়া না পেয়ে থাকেন, তবে অতি সত্বর রোজা ভেঙে ফেলতে হবে।
সবার ক্ষত্রেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে রোজা শুরুর পূর্ব রাত্রি ও চাঁদ রাতে কারণ এ দুই সময়ে ওষুধের কিছুটা তারতম্য হয়। উক্ত দুই সময়ের ব্যবস্থাপত্র আপনার ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন ।
রমযানে রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণের জন্য অতি মাত্রায় শর্করা ও ফ্যাট জাতীয় খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং যেসব রোগী কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ খেয়ে থাকেন, তা পূর্বের নিয়মে চলবে। একইভাবে প্রেসারের ওষুধও পূর্বের নিয়মে চলবে। কিন্তু প্রেসার চেক করে যদি কমে গিয়ে থাকে তবে ওষুধের মাত্রা পুনঃনির্ধারণ করতে পারেন। তবে প্রেসারের ডাইউরেটিক্স জাতীয় ওষুধ সেবন না করাই ভালো। যদি করতেই হয়, তবে তা ইফতারে খাবেন।
এ ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। রমজানকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা কিছুটা জটিল। এর জন্য প্রয়োজন রোগীর এ বিষয়ে সঠিক ধারণা ও চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত খাদ্যাভ্যাসগুলো সঠিকভাবে মেনে চলার মানসিকতা। অনেকে মনে করেন, যেহেতু সারাদিন রোজা রেখেছেন, তাই ইফতারে চিনি দিয়ে শরবত বা জিলাপি খেলে এমন কিছু হবেনা। কিন্তু তা ঠিক নয়। এতে ডায়াবেটিস অতি মাত্রায় বেড়ে গিয়ে জটিলতা তৈরি করতে পারে যা আপনার পরবর্তী রোজাগুলো সঠিকভাবে পালনে অন্তরায় হতে পারে। তাই খাদ্যাভ্যাস, ব্যয়াম ও ওষুধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। এংকর বার্তা