বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

বাংলা, বাংলা ভাষা, বাংলা সন: মুসলমানদের অবদান

কাজী আরিফুর রহমান: বাংলার সমৃদ্ধি, বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বাংলা সন প্রবর্তণে মুসলমান ও মুসলিম শাসক ও মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের অবদান কতটুকু এ বিষয়ে আলোচনা সময়ের দাবী। সংক্ষিপ্ত পরিসরে আজকে আমরা বাংলা, বাংলা ভাষা, বাংলা সন: মুসলমানদের অবদান বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করবে।
বাংলা (বাঙলা)
১২০৪ সালে রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলা বিজয় করেন। মুসলমানরা বাংলায় প্রবেশের পূর্বে বাংলাতে কেউ ঐক্যবদ্ধভাবে শাসন বা একটি দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি। বৃহৎ বঙ্গের ধারণা বলতে কিছুই ছিল না। প্রথম দিকে দিল্লীর মুসলিম শাসকরাও তিনটি প্রদেশে বিভক্ত করে বাংলা শাসন করতেন।
রাজা শশাঙ্ক (৭ম শতাব্দী) ও বৌদ্ধ পাল রাজারা ্ঐক্যবদ্ধ বাংলা গড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সুলতান শাসমুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ( ১৩৪২-১৩৫৭) শুধু বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা অঞ্চলগুলো একত্রিত করেননি, তিনি ত্রিহুত, নেপাল, উরিষ্যা ও কামরূপও জয় করেন। বিহার বিজিত হলে চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও কাশী পর্যন্ত বঙ্গের রাজ্যসীমা বিস্তৃত করেন। তিনি ঐক্যবদ্ধ রাজ্যকে বাঙলা হিসাবে নামকরণ করেন। নিজে শাহ ই বাঙ্গালা খেতাব ধারণ করেন। তখন থেকে গ্টোা অঞ্চলের মানুষ নিজেকে বাঙালী হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে যদি কাউকে খেতাব দিতেই হয় তবে ধার্মিক সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে দিতে হয়।
দিল্লীর শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলকের কাছেও তিনি মাথা নত করেন নি। বরং ফিরোজ শাহের বিরুদ্ধে তিনি সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
তার মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য উত্তরসূরী শাহ সিকান্দর ও গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ বাংলার সুনাম বিশ্ব দরবারে নিয়ে যান। শিক্ষা দীক্ষা, অর্থনীতিতে বাংলা খ্যাতির শীর্ষে চলে যায়। চৈনিক দূত মা হুয়ানের রচনা থেকে সে সময়ের বাংলার গৌরবময় ইতিহাস জানা যায়।
বাংলা ভাষা
সুলতানী আমলে বাংলাভাষাা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ উৎকর্ষতা লক্ষ্য করা যায়। শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইলিয়াস শাহ তদীয় শাহাজাদাসহ রাজ্যের আমীর ওমরাহদের বাাংলাা ভাষা চর্চার উপর গুরুত্ব দেন। সেন রাজবংশ যেখানে বাংলাকে নরকের ভাষা বলতো সেখানে মুসলমান সুলতানগণ বাংলা কবি সাহিত্যিকদের এতো বেশী পৃষ্ঠােপাষকতা করতেন যে হিন্দু কবি সাহিত্যিকরাও বাংলা চর্চায় মনোনিবেশ করে। কবি কৃত্তিবাস (১৪১৮-১৪৩১) রামায়ন ও মালাধর বসু শ্রীকৃষ্ণবিজয় বঙ্গানুবাদ করেন।
ব্রাক্ষ্মণরা রৌরব নরকের ভয় দেখিয়ে ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ থেকে বিরত রাখতো অথচ সুলতান হোসেন শাাহের পৃষ্ঠপোষকতায় রবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারত অনুবাদ করেন। এভাবে মধ্যযুগে মুসলমান শাসক ও অমাত্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাভাষা ও সাহিত্যে এক নব জাগরণের সৃষ্টি হয়।
পুরো হিন্দু সমাজ বাংলা চর্চায় ছিল অনীহা কেননা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ সাধারণ হিন্দুদের পাঠের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেখানে মুসলিম শাসকরা শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচয়িতা মালাধর বসুকে গুনরাজ খাঁ উপাধীতে ভুষিত করেন।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মোহাম্মদ সগীর প্রথম বাংলা কাব্যগ্রন্থ ইউসুফ জুলেখা রচনা করেন। ১৬শতকে দৌলত উজির বাহরাম খা পারস্যের লোক কাহিনী লাইলী মজনু কাব্য রচনা করে বাংলাকে সমাজের সকল শ্রেণীর নিকট জনপ্রিয় করে তুলেন। এ সময় আরাকানে মহাকবি আলাওল অমর কাব্য পদ্মাবতী কাব্য রচনা করে বাংলা ভাষাকে ব্যাপকভাবে সমাদৃত করেন।
ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে জানা যায় ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন।
বাংলা সন
আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। নববর্ষকে আমরা হৃদয়ের সকল ভালোবাসা দিয়ে স্বাগত জানাই। আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের নিজস্ব একটি সন আছে। পৃথিবীর বহু জাতির নিজস্ব কোন সন বা বর্ষপঞ্জিকা নেই।
ঐতিহাসিকদের মতে এক সময় এ অঞ্চলে হিজরী সন প্রচলিত ছিল। রাজস্ব আদায়ে জটিলতা দূর করতে সম্রাট আকবরের খ্যাতিমান জ্যোর্তিবিজ্ঞানী আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে দায়িত¦ দেন নতুন সন উদ্ভাবনের। ফতেহউল্লাহ সিরাজী হিজরী সনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাসন প্রনয়ন করেন।
কৃষি সভ্যতার উৎপত্তিস্থল মিশরের মতো ঋতুর আবর্তনের সঙ্গে ফসল বোনা, আবাদ, পরিচর্যা ও কর্তনের অনিবার্য সম্পর্ক থাকার প্রেক্ষাপটে চন্দ্রভিত্তিক বর্ষ গণনার স্থলে সূর্যভিত্তিক বর্ষ গণনা প্রাধান্য লাভ করে। সিরাজী শকাব্দের মাস, দিন যেমন- বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, শনি, রবি প্রভৃতি যুক্ত করেন। সে সঙ্গে যুক্ত করেন চন্দ্রভিত্তিক ৩০টি তিথি। তিথিগুলো দুই পক্ষে বিভক্ত।
কৃষিভিত্তিক বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনকর্ম পরিচালিত হয় বাংলাসনে। আর ধর্মীয় বিভিন্ন দিন তারিখ পরিচালিত হয় হিজরী সনে। যেমন রমজান, ঈদ, মুহররম ইত্যাদি।
বাংলা সনের আজকের আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক রূপ দেওয়ার কৃতিত্ব পাকিস্তান আমলে বাংলা একাডেমী ও ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর। বাংলা সনের কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত হয়। এ সমস্যা দূর করতে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় বৈশাখ হতে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের আর আশ্বিন হতে চৈত্র হবে ৩০ দিনের। প্রতি চতুর্থ বছর ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত ১ দিন যোগ করে ৩১ দিনের হবে।
পলাশীর বিপর্যয়ের পর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণার নামে হাজার হাজার দেশি শব্দ ও আরবী ফারসী শব্দ বিতাড়িত করে সংস্কৃত শব্দের সমারোহ গড়ে তোলে অথচ বাংলা সনের আধুুনিকরণে কোন উদ্যোগ ছিল না।
পরিশেষে বলতে হয়, এভাবে পুরো মধ্যযুগ ছিল বাংলা, বাংলা ভাষার স্বর্ণযুগ। যে যুগকে অনেকে অন্ধকার যুগ বলে অথচ বাংলা একটি সমৃদ্ধ জনপদ, বাংলা ভাষা ব্যাপক চর্চা হয় মধ্যযুগে। মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি আবদুল হাকিম তার নুর নামা কাব্যগ্রন্থে লিখেন ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহারো জন্ম নির্ণয়ে ন জানি’। বৃটিশ কলোনীযুগেও মীর মোশাররক হোসেন, ঈসমাইল হোসেন সিরাজী, কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাভাষার সমৃদ্ধে রাখেন অন্যবদ্য অবদান। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের অবদানতো আমাদের সামনেই আছে। বৃটিশ খেদাও আন্দোলনেও ছিল বাংলার মুসলিম বীর নিসার আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়তউল্লাহ, ফকির মজনু শাহের সংগ্রামমুখর ভুমিকা। যা ইতিহাসে থাকলেও রাষ্ট্রৃীয়ভাবে আলোাচনায় আসছে কম। এ আলোচনা বাড়াতে হবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক: জাতীয় সাংষ্কৃতিক ফোরাম- জাসাফ

আরো পড়ুন ...