বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪
মানব জমিন প্রতিবেদন। বিরল এক বিকালের সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। তুমুল লাল বিপ্লবে উড়ে গেল ১৫ বছরের বেশি স্থায়ী শেখ হাসিনার সরকার। পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। সঙ্গে গেছেন তার ছোট বোন শেখ রেহানাও। এক মাস পাঁচদিন স্থায়ী লাল বিপ্লবীদের কোটা বিরোধী আন্দোলনে শুধু সরকারের পতনই হয়নি, দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে সরকার প্রধানকে। গতকাল দুপুরের পর হঠাৎ দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন এই খবর প্রকাশের পর ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসতে থাকেন। বিজয় উৎসব শুরু হয় চারদিকে। বেলা আড়াইটার পর জানা যায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এরপর আন্দোলনে জয়ী মানুষের বাঁধভাঙা স্রোত ছড়িয়ে পড়ে সড়কে।
অলি-গলি, পাড়া- মহল্লায়, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। রাজধানীর রাজপথ হয়ে ওঠে আন্দোলন বিজয়ী ছাত্র-জনতার বিজয়ের ক্যানভাস। কোটি মানুষের স্রোতের অংশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে। এ সময় তারা এসব ভবনে নানাভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এ সময় লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। বিকাল চারটার আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের তথ্য জানান। একইসঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করবে বলে জানান। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে শান্ত থাকারও আহ্বান জানান তিনি। ভাষণ দেয়ার আগে রাজনৈতিক দলের নেতা সুুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেন সেনাপ্রধান। পরে রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে আলোচনা করতে বিভিন্ন দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সেনা কর্মকর্তারা বঙ্গভবনে যান।
দুপুরের পর খবর আসে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বেলা আড়াইটায় বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। রাতে জানা যায় নয়া দিল্লির সামরিক ঘাঁটিতে তিনি নামেন। তবে ভারতে থাকবেন নাকি অন্য কোনো দেশে যাবেন তা রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ছাত্র-জনতার একদফা পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সোমবার ‘মার্চ টু ঢাকা’- কর্মসূচির দিনে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। যদিও দিনের শুরুটা হয় নির্মমতা দিয়ে। আগের কয়েক দিনের সহিংস ঘটনার জেরে গতকালও আন্দোলনকারীদের ওপর বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালায়। এদিন ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত ৪৫ জনের মৃত্যু হয়। আগের দিন থেকেই আলোচনা ছিল ছাত্র-জনতা গণভবন ঘেরাও করতে যাবে। এ নিয়ে ছিল নানা প্রচারণা। উত্তাপ-উত্তেজনার মধ্যে গতকাল দুপুরের পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। আগের দিন থেকেই মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়েছিল। ইন্টারনেট বন্ধ থাকা সকাল থেকে ছিল নানা গুজব আর গুঞ্জন। দুপুরের পর দৃশ্যপট পরিষ্কার হতে থাকে।
থমথমে অবস্থার মধ্যে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসতে থাকেন। অনেকটা বিজয় মিছিলের আবহে ছাত্র-জনতা শাহবাগ ও গণভবনের দিকে যেতে থাকেন। বেলা দুইটার দিকে পুরো রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো ছাত্র-জনতার দখলে চলে যায়। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সবাই রাজপথে নেমে এসে বিজয়ের উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন এই খবর প্রচার হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও বদলে যেতে থাকে। ছাত্র-জনতার স্রোত ছড়িয়ে পড়ে অলি-গলি, গ্রাম- গ্রামান্তরে। অপূর্ব এক উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো দেশ। গত কয়েকদিনের ছাত্র-জনতার রক্তস্রোতের ওপর দাঁড়িয়ে পালন করা এই বিজয় উল্লাসের মাঝেও মানুষের মধ্যে ছিল ক্ষোভের আগুন, শোকের কান্না, আর হৃদয় ছেঁড়া হাহাকার। হাতে হাতে জাতীয় পতাকা, বিজয়ের নানা চিহ্ন আর ফুল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসা জনতার গগনবিদারী স্লোগানে ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে জীবন দেয়া বীর শহীদদের নাম। গত কয়েকদিনে অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করা বীর শহীদদের পরিবারের কাছেও কৃতজ্ঞতা জানাতে ছুটে যান আন্দোলনে বিজয়ী ছাত্র-জনতা। সোমবারের বিকালটি বিজয়ের এক আভায় উদ্ভাসিত হয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এমন বিকাল আর আগে আসেনি এমনটা বলছিলেন আন্দোলনে বিজয়ীরা। বিরল এক গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হয়েছে দেশ। দুনিয়ার গণতান্ত্রিক ইতিহাসে জনতার এই অভ্যুত্থানও স্বর্ণের অক্ষরে লেখা থাকবে যুগ-যুগান্তরে।
বিস্ময়কর এই গণঅভ্যুত্থানের বিকালে উল্লসিত জনতার স্রোত প্রবেশ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে। সেখানকার সব নিরাপত্তা চৌকি চুরমার করে জনতার স্রোত সেখানে নানাভাবে উল্লাস প্রকাশ করে। ছিল অনাকাঙ্খিত দৃশ্যও। লুটপাট করে জিনিসপত্র নিয়ে যেতে দেখা যায় অনেককে। একই সময়ে আন্দোলনে বিজয়ী ছাত্র-জনতার স্রোত প্রবেশ করে জাতীয় সংসদ ভবনে। সেখানেও তারা নানাভাবে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশ করে উল্লাস প্রকাশ করেন তারা। বিকালেই বন্ধ ঘোষণা করা হয় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম। সারা দেশে বিজয় উল্লাস প্রকাশ করার সময় ঘটে নানা ঘটনাও। হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করার তথ্য ও পাওয়া যায়। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সবাইকে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদ ধ্বংস না করার আহ্বান জানানো হয়। সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সরকারের একটি রূপরেখা দেয়ার তথ্যও জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়। বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোও সব ধরনের সংঘাত সহিংসতা পরিহার করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানায়।
রাজধানীতে ছাত্র-জনতার জয়োল্লাস চলার সময় ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের তথ্য পাওয়া যায়। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ছাড়া কাওরান বাজারে অবস্থিত একটি গণমাধ্যমের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও হামলা করে দুর্বৃত্তরা। আক্রান্ত হয় প্রধান বিচারপতির বাসভবনও।
আগের দিন রোববার ছাত্র-জনতার সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি শুরুর দিনে সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের অস্ত্রধারী ক্যাডারদের আক্রমণ, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে এবং আন্দোলনকারীদের হামলায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এরমধ্যে বেশির ভাগ মানুষ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা ও গুলিতে মারা যান। এ ছাড়া হামলায় ১৪ জন পুলিশ সদস্য ও আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী নিহত হন। এদিনের নজিরবিহীন সহিংসতায় কয়েক হাজার মানুষ আহত হন।
ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন প্রতিরোধে রোববারই সারা দেশের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে আসে। আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী, নেতাদের বাসায় হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। খবর ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা পালিয়ে যাচ্ছেন। এমন অবস্থায় সোমবার মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘিরে তৈরি হয় উদ্বেগ। সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে। নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় সড়কে। দুপুর পর্যন্ত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়ে আন্দোলনকারীদের দিকে।
গত ১লা জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরপর ধাপে ধাপে এই আন্দোলন রূপ নেয় একদফায়। গত ১৬ই জুলাই আন্দোলন চলাকালে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে প্রতিবাদ করার সময় নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে পুলিশ। এতে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান। তার প্রতিবাদের এই ছবি এবং ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। তিনি হয়ে উঠেন এই আন্দোলনের অদম্য এক প্রতীকী শক্তি। এরপর ক্রমে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সরকারের বর্বর দমন-পীড়নের নানা ধাপে প্রায় চারশ’ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। তাদের প্রায় সবাই ছাত্র-জনতা। এতো বিপুল মানুষের প্রাণহানি স্বাধীন বাংলাদেশের জমিনে এর আগে কখনো একক আন্দোলনে হয়নি।
শেখ হাসিনার উত্থান-পতন: আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আগমন অনেকটা আকস্মিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে সপরিবারে নিহত হন। তখন তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর থেকে তিনি এ পর্যন্ত দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর এক এগারোর অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জেরে ২০০৮ সালে হওয়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে একটি বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে তিনি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সে সময়ের নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ছিল দেশে-বিদেশে। বিএনপি-জামায়াতসহ ২০১৪ সালে বিরোধী জোট শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন বর্জন করে। এতে অর্ধেকের বেশি আসনে এমপি হয়ে যান বিনা ভোটে। পরে ওই সরকারকে অনেকে বিনা ভোটের সরকার আখ্যায়িত করেন। বিরোধী দলেগুলোর দাবি উপেক্ষা করে এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি পুনরায় তার অধীনে নির্বাচন আয়োজন করেন। ওই নির্বাচনে বিরোধীরা অংশ নিলেও তাতে বিরোধীদলীয় নেতাদের প্রায় সবাই হেরে যান। তখন বলা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় রাতে ভোট দেয়া হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চতুর্থ বারের মতো ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। ওই নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। এতে আওয়ামী লীগের নেতারাই বিকল্প প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনকে বিরোধীরা ডামি নির্বাচন বলে আখ্যা দেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগ থেকে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো। তারা এ দাবিতে সময়ে সময়ে যেসব আন্দোলন করেছে তাতে আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলায় বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী আহত ও গুম হয়েছেন। কারাগারে যেতে হয়েছে কয়েক লাখ নেতাকর্মীকে। এ ছাড়া বিরোধী নেতাকর্মীরা নানা ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একাধিক মামলায় ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত কারান্তরীণ করে রাখা হয়।