শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
সারাদেশে গ্যাসের তীব্র সংকটে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে উৎপাদন কমে এসে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের গ্যাস সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গাজীপুরের শিল্পাঞ্চল। গত কয়েকদিনে এখানকার তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছে। সাভার, কোনাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশের শিল্পাঞ্চলে চলছে এই সংকট।
কারখানার মালিকরা বলছেন, বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকার কথা থাকলেও অনেক কারখানায় চাপ কমে প্রতি ঘনফুটে ২ থেকে ৩ পিএসআইতে বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এলএনজি আনা হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় কম। তাই এখন দিনে ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ।
শিল্পমালিকরা বলছেন, একদিকে ডলার ক্রাইসিস অন্যদিকে গ্যাস সংকট চলতে থাকলে এই সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। তারা বলেন, বেশ কিছুদিন হলো গ্যাসের সংকট তেমন ছিল না। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকে সংকট দেখা দিয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বেশিরভাগ এলাকায় দিনের বেলায় কল-কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
সময় মতো কাঙিক্ষত উৎপাদন করতে না পারায় আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছেন শিল্প কারখানার মালিকরা। এছাড়া পোশাক ক্রেতাদের চাহিদামতো সময়ে উৎপাদন সরবরাহ করতে না পারলে অনেক সময় অর্ডার বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যার কারণে শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরের কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ যাতে স্বাভাবিক থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ার দাবি করেছেন শিল্প কারখানার মালিকরা।
কালিয়াকৈর উপজেলার খাড়া জোড়া নামক এলাকার এসএ স্পিনিং মিলসে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সংকটের কারণে সুতা তৈরির মেশিন চালাতে পারছেন না। ফলে অর্ধেকের বেশি মেশিনগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তার এ সুতা তৈরির করাখানায় মোট ৪০টি মেশিন থাকলেও গ্যাসের চাপ কম থাকায় ১২টি মেশিন চালাতে হচ্ছে। দিনের বেশিরভাগ সময় গ্যাসের চাপ না থাকায় উৎপাদন নেই বললেই চলে। গ্যাস সংকট থাকায় এই সুতা তৈরির কারখানায় দুটি জেনারেটর বন্ধ রয়েছে। ফলে মেশিন বন্ধ রেখে শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতনভাতা দিতে হচ্ছে। বিষয়গুলো নিয়ে গ্যাস কোম্পানিদের একাধিক অভিযোগ দিয়েও কোনো সুরাহা পাওয়া যাচ্ছে না বলে এ কারখানার কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন।
কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর যমুনা স্পিনিং ডিভিশনের জিএম (প্রশাসন ও মানব সম্পদ) লিয়াকত হোসেন বলেন, দিনভর কারখানায় গ্যাস থাকে না। কারখানার চার শিফটের মধ্যে এক শিফট কাজ চলে; বাকি তিন শিফট কাজ করানো যাচ্ছে না। কারখানার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আনা যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন মারাত্বক ব্যাহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কারখানার শ্রমিকদের বেতন দিতে কষ্ট হবে।
কালিয়াকৈর পুর্বচান্দরা বোর্ড মিল এলাকার লিজ ফ্যাশন ও লিডা টেকস টাইল কারখানা জিএম জাহাঙ্গীর আলম জয় জানান, বেশিরভাগ সময়ই গ্যাসের চাপ কম থাকায় কারখানা চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কারখানায় গ্যাসের চাপ প্রয়োজন হয় ৬ পিএস আই আমরা ৩ পিএসআই পাচ্ছি না। গ্যাসের চাপের কারণে যে পরিমাণ উৎপাদন করার কথা সেই পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে না। কারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকায় খান ব্রাদার্স কারখানার এমডি হযরত আলী জানান, গ্যাসের চাপ বাড়ানোর দাবি জানানো হলেও কোনো উন্নতি হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে ভালো হলেও সপ্তাহে অন্তত দুই থেকে তিনদিন গ্যাসের চাপ থাকে না।
কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকায় ব্যবসায়ী নাহিদুল ইসলাম জানান, কারখানায় গ্যাসের চাপ ৫ পিএসআই বেশি উঠে না। বাধ্য হয়ে ডিজেলের জেনারেটর চালাতে হয়। এভাবে ডিজেল ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তখন লোকসান গুনতে হবে।
এসএ স্পিনিং মিলস লিমিটেডের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মো. তালেবুর রহমান বলেন, গত ছয় মাস ধরে গ্যাস সংকটে এই স্পিনিং মিল বন্ধের উপক্রম হয়ে যাচ্ছে। যেখানে মোট ৪০টি সুতা তৈরির মেশিন চালাতে ১০ পিএস গ্যাস লাগে; সেখানে প্রতিদিন গ্যাসের চাপ পাচ্ছি ১ থেকে দেড় পিএস। ফলে অর্ধেকের বেশি মেশিন বন্ধ রেখে শ্রমিক কারখানায় বসিয়ে রাখা হচ্ছে। এ কারণে প্রতি মাসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী গণমাধ্যমকে বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে গ্যাস-সংকট চরম অবস্থায় চলে গেছে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার; গাজীপুরের শ্রীপুর ও সাভার এলাকায় সংকট বেশি। এসব এলাকার ডাইং কারখানাগুলো বেশি ভুগছে। গ্যাস সমস্যা নিয়ে পেট্রোবাংলা কিংবা তিতাসের উচ্চপর্যায়ের কেউ কোনো কথা বলে না। এখন কাউকে ফোন দিলেও পাওয়া যায় না। বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে সরবরাহ রয়েছে ২৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলাসহ জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গ্যাস সংকটের কারণে ২০২০ সালের এপ্রিলের পর এবারই দেশে গ্যাসের সরবরাহ সর্বনিম্ন। এই সরবরাহ ২০২১ সালের শেষ ছয় মাসের গড় সরবরাহ থেকেও কম। সে সময় ডলারের অভাবে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ ছিল। এলএনজির দামও তখন ছিল আকাশছোঁয়া।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহসভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, পোশাক কারখানাগুলো উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার জন্য অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং প্রয়োজনীয় গ্যাস আমদানি করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি। বর্তমানে গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হলেও আমাদের চাহিদা পূরন হচ্ছে না।
তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি গাজীপুর জোনের ডিজিএম মো. শাহাজাদা ফরাজী বলেন, গাজীপুরে যে পরিমাণে গ্যাসের চাহিদা সেই পরিমাণে গ্যাস পাওয়া যায় না। যার কারণে কিছু কিছু এলাকায় গ্যাসের সংকট রয়েছে। এছাড়া অনেক এলাকায় আবাসিকের সংযোগে পাইপগুলো পুরাতন হয়ে যাওয়ায় বাসাবাড়িতেও গ্যাসের সমস্যার রয়েছে। সেগুলো ধীরে ধীরে সমাধান করা হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, যে ভাসমান টার্মিনালটি সংস্কারের জন্য বন্ধ ছিল সেটি শিগগিরই চালু হবে। এটি চালু হলে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা বাড়বে। তার মতে, দুটো টার্মিনাল মিলে গ্যাস সরবরাহ করে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর যেটি চলছে, সেটি বর্তমানে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো সরবরাহ করছে।
তবে পেট্রোবাংলার আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এটি ভাসমান টার্মিনাল বহরে যুক্ত হলেও আরেকটি টার্মিনাল সংস্কারের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। আর একটি যোগ হলেও সর্বোচ্চ ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো বাড়বে, যা চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত নয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, মূলত সবচেয়ে বেশি উৎপাদনকারী বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রসহ স্থানীয় ক্ষেত্রগুলোতেও গ্যাসের উৎপাদনও কমে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে, যা খুব সহসায় কাটবে না।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার সাংবাদিকদের বলেছেন, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। তবে আমরা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। আমাদের ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে। ইতোমধ্যে আমরা প্রায় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন করছি। তাৎক্ষণিক এই গ্যাস সংকট মোকাবিলায় এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন জনেন্দ্র নাথ সরকার। তবে বর্তমানে ডলার মজুতের যে অবস্থা, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের আমদানি বাড়ানোর সম্ভাবনাও কম। যুগান্তর