রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
বিবিসি বাংলা:: বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় অতিভারী বৃষ্টিপাতের কারণে পানি বন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে যে, সবচেয়ে বেশি বন্যাক্রান্ত হয়েছে বান্দরবান জেলা। এরপর রয়েছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলা। এছাড়া ফেনী জেলার কিছু এলাকা বন্যাক্রান্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলার কমপক্ষে ১৫টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। পানি বন্দী অবস্থায় রয়েছে লাখ লাখ মানুষ। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাত ও বন্যায় জেলাটিতে এ পর্যন্ত দুই জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
বান্দরবান জেলার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে যে, গত তিন দিনে জেলাটিতে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে প্রায় শতাধিক পাহাড় ধস হয়েছে। এতে কমপক্ষে দুই জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে সংস্থাটি। আর এক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পাহাড় ধসে বেশ কয়েক জন আহত হলেও তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়।
কক্সবাজার জেলার চকোরিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদি বলেন, শুধু তার উপজেলাতেই এক লাখেরও বেশি মানুষ পানি বন্দী অবস্থায় রয়েছে। কমপক্ষে ১০টি ইউনিয়ন বন্যাক্রান্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কিছু অংশ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে বান্দরবান জেলা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসন থেকে জানা গেছে, গত তিন দিন ধরে এই জেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। একই সাথে বন্ধ রয়েছে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কও।
রাঙ্গামাটি জেলায় গত দুই দিনে প্রায় ১০-১২টি জায়গায় পাহাড় ধস হয়েছে। এতে কয়েকটি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এগুলোর কোনটিই বড় ধরনের ধস ছিল না।
গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতের কারণে চট্টগ্রামের অনেক এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ১৫টি উপজেলার সবকটিই কম-বেশি প্লাবিত হয়েছে।
শুধু সন্দ্বীপ ও ফটিকছড়ি উপজেলা ছাড়া বাকি ১৩টি উপজেলাই খুব বেশি প্লাবিত হয়েছে। সাতকানিয়া উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
মি. ফখরুজ্জামান বলেন, “লোহাগড়া উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে, চন্দনাইশের ছয়টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে এবং প্রচুর মানুষ পানি বন্দী অবস্থায় আছে। এই ইউনিয়নগুলোতে প্রচুর মানুষ।”
সাতকানিয়া এবং লোহাগড়া উপজেলায় বন্যাক্রান্ত মানুষদের উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে এবং এরইমধ্যে তারা কাজ শুরু করেছে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে নৌকা না থাকার কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে বলেও জানানে হয়।
রাউজান ও লোহাগড়ায় পানিতে ডুবে এক জন করে মারা গেছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম-বান্দরবান মহাসড়কের সাতকানিয়া অংশের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার মতো মহাসড়কে পানি উঠেছে। দুই ফুট থেকে শুরু করে এই মহাসড়কের কোথাও কোথাও সাত ফুটের মতো পানি আছে।
ট্রাক চলাচল কিছু কিছু এলাকায় চালু থাকলেও অন্যান্য যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
“কক্সবাজার ও বান্দরবানের সাথে শুধু সাতকানিয়া অংশ বাদ দিলে আমাদের বাকি অংশে যোগাযোগ কোন সমস্যা নেই। সেগুলো যান চলছে।”
সাতকানিয়া ও লোহাগড়া এলাকার কিছু কিছু জায়গায় গত দুই দিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে না মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবাও।
বান্দরবান জেলার ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দী বিবিসি বাংলাকে বলেন, অতিভারী বৃষ্টিপাতের কারণে জেলার সদর উপজেলা সবচেয়ে বেশি বন্যাক্রান্ত হয়েছে।
এই জেলায় মোট ১৯১টি আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে বন্যাক্রান্তদের সহায়তার জন্য। উদ্ধার কাজ ও ত্রাণ তৎপরতায় সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে বলেও জানানো হয়।
তিনি বলেন, লামা, রোয়াংছড়ি, আলীকদম উপজেলায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। রাস্তার উপর থেকে মাটি ও গাছপালা সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছে।
মি. মুৎসুদ্দী বলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা কমে যাওয়ার কারণে বন্যার পানিও কমতে শুরু করেছে।
“গতকাল যে উচ্চতা ছিল ওখান থেকে প্রায় ২০ ফিট পানি কমে গেছে,” বলেন তিনি।
তবে জেলার নিম্নাঞ্চলগুলো এখনো পানির নিচে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর বেশিরভাগ বিশেষ করে কালভার্ট এলাকা তলিয়ে যাওয়ার কারণে জেলার অভ্যন্তরীণ যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
অন্যান্য জেলার সাথে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।
বিদ্যুৎ সংযোগের তার ডুবে যাওয়ার কারণে এবং কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যাওয়ায় গত তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে এই জেলাটি।
এছাড়া বেশিরভাগ এলাকায় মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
সদর উপজেলার ১০ শতাংশ পানির নিচে রয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে প্রায় তিন হাজার বাড়ি-ঘর।
কক্সবাজার জেলার চকোরিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদি বলেন, তার উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা পানির নিচে। এখনো প্রায় এক লাখ মানুষ পানি বন্দী অবস্থায় রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তার উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের মধ্যে বেশিরভাগই বন্যাক্রান্ত। এর মধ্যে ১০টি ইউনিয়নের অবস্থা বেশ খারাপ বলে জানান তিনি।
তবে মঙ্গলবার পানির উচ্চতা না বাড়লে সেটি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।
মি. করিম বলেন, উপজেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণে বন্যার ত্রাণ তারা পানি বন্দী মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না।
“উপজেলা থেকে আমরা ২০ টন চাল দিসি সেইগুলাই চেয়ারম্যানরা বিতরণ করতে পারে নাই,” বলেন তিনি।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কিছু কিছু এলাকায় পানি উঠে গেছে। দোহাজারী, লোহাগড়া, আমিরাবাদ এলাকায় মহাসড়কে পানি উঠে গেছে। ফলে যানবাহন চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
“গতকাল যেসব গাড়ি ঢাকা থেকে গেছে যেগুলি সেগুলো কক্সবাজার পৌঁছায় নাই। কক্সবাজারের গুলি ঢাকায় পৌঁছায়ছে মাত্র(সন্ধ্যা নাগাদ), চলাচল করতে দুই দিন লেগে যাচ্ছে। কয়েকটা গাড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে আরকি।”
চকোরিয়া উপজেলাতেও গত দুই দিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে বলে জানান তিনি।
“পল্লী বিদ্যুৎ একেবারেই নাই। পিডিবি একটু আসছিলো, আবার গেছে গা।”
পেকুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তার উপজেলার অনেক এলাকা এবং ইউনিয়ন পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শুধু পেকুয়া সদর ইউনিয়নেই প্রায় ১০-১৫ হাজার মানুষ পানি বন্দী অবস্থায় রয়েছে। সেখানে পানি এখনো বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সোমবার সকাল থেকে গ্রামগুলোতে পানি উঠতে থাকে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মি. আলম বলেন, “আমার উপজেলায় সব ইউনিয়নই আক্রান্ত। সাতটা ইউনিয়ন আছে, সব কয়টা আক্রান্ত। দুই একটা ইউনিয়ন যাও ছিল আজ পাহাড়ের পানি আসার কারণে সকাল থেকে বৃষ্টি হওয়ার পরে সবগুলো আক্রান্ত হয়ে গেছে।”
সবগুলো ইউনিয়ন মিলে প্রায় ৫০-৬০ হাজার মানুষ পানি বন্দী অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন পেকুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান।
শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে বন্যাক্রান্ত মানুষ।
উপজেলায় সোমবার কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলেও মঙ্গলবার সকাল থেকে সারা দিন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম জানান, এই উপজেলায় পানি বাড়তে থাকার কারণে রাস্তাঘাট তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে যান চলাচল বেশিরভাগ রাস্তায় বন্ধ হয়ে গেছে। মহাসড়কের চন্দনাইশ, পটিয়া এলাকা পানির নিচে থাকায় তা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, অগাস্ট মাসে এ ধরণের অতি ভারী বৃষ্টিপাত হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে অতীতে এই সময়ে এর চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের উপর দিয়ে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে খুলনা-বরিশাল-চট্টগ্রাম-সিলেট বেল্টে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত হয়। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ বা নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে সেটি উপকূল অতিক্রম করার সময় বৃষ্টিপাত হয়।
গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাত মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে হচ্ছে। আগামী দুই দিনে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা কমে যাবে। তবে আগামী ১১-১৩ই অগাস্ট আবারো হালকা থেকে মাঝারী বৃষ্টিপাত হবে। সেই সাথে কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রামে গত দোসরা অগাস্ট থেকে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত টানা ১১ দিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে বলে জানান মি. মল্লিক। বৃষ্টিপাতের অতীত রেকর্ডগুলোর মধ্যে ২০০৭ সালে ৬১০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। সেসময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ভূমিধসের কারণে ১২৮ জন মানুষ মারা গিয়েছিল।
দু’হাজার এগারো সালে টানা ছয় দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
এছাড়া ২০১৭ সালে পুরো চট্টগ্রাম বিভাগ জুড়ে ব্যাপক বৃষ্টির পর ভূমিধসে মোট ১৬৯ জন মানুষ মারা গিয়েছিল।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, বন্যা পরিস্থিতি এরইমধ্যে উন্নতি হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বান্দরবানে পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।
এই এলাকায় এখনো বৃষ্টিপাত হলেও তার তীব্রতা কমে আসার কারণে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ার কারণে আগামী কয়েক দিন বৃষ্টিপাত কমে গেলে বন্যার পানি নেমে যাবে বলে ধারণা করছেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এই কর্মকর্তা।
“বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে আমরা যতটুকু দেখছি। আগামী দু-তিনদিন যদি বৃষ্টিপাত কম হয় তাহলে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে,” বলেন মি. হাসান।