রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

দেশজুড়ে তীব্র লোডশেডিং, বিপর্যস্ত জনজীবন

দেশব্যাপী গত দুই সপ্তাহ ধরে বইছে তাপদাহ। এরমধ্যেই দেশজুড়ে হচ্ছে প্রচণ্ড লোডশেডিং। এতে অসহ্য গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শহরের তুলনায় গ্রামে লোডশেডিং হচ্ছে বেশি। গ্রামাঞ্চলে দিনে-রাতে ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টারও বেশি বিদ্যুৎ থাকছে না। লোডশেডিংয়ের নেই কোন শিডিউল। যখন-তখনই চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। অনেক গ্রামে রাতে বিদ্যুৎ একবার গেলে আর আসেই না। এতে ফুঁসে উঠছে মানুষ। অনেক এলাকার বিক্ষুব্ধ মানুষ বিদ্যুৎ অফিসে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে।

রেকর্ড সংখ্যক উৎপাদনের পরও লোডশেডিংয়ের কারণে অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কয়েকদিন ধরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, কোনাবাড়ী, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ এলাকার পোশাকসহ অন্যান্য কারখানায় উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে ঈদের আগে ব্যবসা-বাণিজ্য চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা।

জানা যায়, গ্রামে অর্থাৎ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাভুক্ত এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। লোডশেডিংয়ে বেশি নাজুক ৬৩টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি।

পিডিবি অফিস সূত্র জানিয়েছে, গতকাল ১৭ই এপ্রিল দেশের রেকর্ড সংখ্যক সর্বোচ্চ ১৫,৬০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন  হয়েছে। এর আগে ১৩ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এরপরও গরমের কারণে বিদ্যুতের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে।

এদিকে রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো হলেও গ্রামাঞ্চলের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে রাতে ঘুমাতে পারছে না মানুষ। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন। রোববার রাতে ফেনীর ছাগলনাইয়ায় বিদ্যুৎ অফিসে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা।

ছাগলনাইয়া পল্লী বিদ্যুৎ জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) মো. জানে আলম জানিয়েছেন, ‘বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে বিক্ষুব্ধ দুই সহস্রাধিক জনতা বিদ্যুৎ অফিসে হামলা চালিয়ে অফিসের গেট, আসবাবপত্র, দরজা ও জানালার কাচ ভাঙচুর করেছে। এ সময় ভয়ে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন।

এ বিষয়ে সোমবার এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, গরম বেশি পড়লে বিদ্যুতের তার গরম হয়, তখন ঝুঁকিও বাড়ে।’ সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের জন্য এটাও কারণ হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের অবস্থা আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। কিছুদিন আগেও পরিস্থিতি ভালো ছিল না। জ্বালানি সংকটের মধ্যে এখন আর বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব না।

জানা গেছে, এখন সারা দেশে সরকারিভাবে ১০০০ মেগাওয়াটের মতো লোডশেডিংয়ের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা আরও বেশি। বিতরণ কোম্পানিগুলোর হিসাবে এই লোডশেডিং ১৫শ থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় এখন গড়ে ১৪ হাজার ৫০০ থেকে সাড়ে ১৫ হাজারের ওপরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এবার গরমের কারণে অন্য বছরের তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ ১১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর জন্য কিছুটা বিপাকে পড়েছে পিডিবি। না-হলে চলতি বছর আরও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হতো।

১৬ই এপ্রিল উৎপাদন লক্ষ্য ধরা হয় ১৩ হাজার ৯৪৮ মেগাওয়াট। অবশ্য আগের দিন শনিবার নিট উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৯৭৮ মেগাওয়াট। এরপরও পিডিবির হিসাবে সারা দেশে ৯৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। সব চেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে ময়মনসিংহ জোনে। এখানে দৈনিক ১৯৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানান, তাদের কোনো লোডশেডিং করতে হচ্ছে না। কিছু উপকেন্দ্রে সমস্যার কারণে কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ থাকে না। এটাকে লোডশেডিং বলা যাবে না। সোমবার সর্বোচ্চ ১৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে ডিপিডিসি এলাকায়।

তবে পিডিবি জানিয়েছে, ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোয় সব মিলিয়ে ৬০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হচ্ছে। ঢাকায় সব মিলিয়ে চাহিদা ৫ হাজার ২২০ মেগাওয়াট। সরবরাহ করা হচ্ছে ৫ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট।

এক সপ্তাহ থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং বাড়তে থাকে। ১৩ এপ্রিল রাত ৯টায় দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট। সেসময়ও ঢাকায় ৩০৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। ১৪ এপ্রিল লোডশেডিং ছিল সর্বোচ্চ ১ হাজার ২৮০ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। সোমবার বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৪ হাজার ১০৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ৮৯৬ মেগাওয়াট। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রকৃত লোডশেডিং আরও বেশি। সূত্রের তথ্যমতে, সোমবার বিদ্যুতের ঘাটতি দুই হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়। সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদিত না হওয়ার জন্য জ্বালানি সংকট এবং কেন্দ্র মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য বন্ধ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা।

দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) প্রধান প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় তারা লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীন নগরীর বর্ধিত অংশে দুদিন ধরে বিদ্যুৎ শুধু যাচ্ছে আর আসছে। রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি রেজাউল ইসলাম মিলন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আধা ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করায় ঈদের আগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্রেতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। রংপুর বিভাগের আট জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ৯০০ মেগাওয়াট। বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট।

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ১৫-২০ মিনিট থেকে পুনরায় বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। একবার গেলে আর আসার নাম নেই। রোববার ভোর ৪টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত ১৪ ঘণ্টায় আটবার বিদ্যুৎবিভ্রাট হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দৈনিক ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। পিরোজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি দুই ঘণ্টা পর এক ঘণ্টা লোডশেডিং করছে। ঝিনাইদহের অধিকাংশ এলাকায় ইফতার, তারাবি ও সেহরির সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চার-পাঁচ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না।

এদিকে সিলেটে মাত্রাতিরিক্ত বিদ্যুৎবিভ্রাটের যন্ত্রণায় নগরীতে মধ্যরাতে সড়ক অবরোধ করেছেন স্থানীয়রা। তবে সড়ক অবরোধের প্রায় ১৫ মিনিট পর বিদ্যুৎ চলে এলে তারা অবরোধ তুলে নেয়। গত রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর নয়াসড়ক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, ওই এলাকায় ইফতারের আগ থেকেই বিদ্যুৎ ছিল না। বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ইফতার ও তারাবির নামাজ পরে রাত ১১টার দিকে বাধ্য হয়ে তারা সড়ক অবরোধ করেন। তিন দিন ধরে সিলেটের সব এলাকায়ই চলছে চরম বিদ্যুৎবিভ্রাট। একদিকে রমজান, অন্যদিকে গরমের উত্তাপ। এমন পরিস্থিতিতে কয়েকদিন ধরেই সিলেটে বিদ্যুৎ থাকছে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ইফতারের সময় যেমন বিদ্যুৎ চলে যায়, তেমনই রাতে সেহেরির সময়ও বিদ্যুৎ চলে যায়। দিন-রাত মিলিয়ে ৮-১০ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না সিলেটবাসী। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। মানব জমিন

আরো পড়ুন ...