বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত হলো তুরস্কের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। আগে ও পরে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়েছে এই নির্বাচন। একটি দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন যে এত আলোচনার জন্ম দিতে পারে তা সচরাচর দেখা যায় না। বহুল আলোচিত এই নির্বাচনে মোট ভোটের হারে জয় হয়েছে ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এ কে) পার্টির। অবশ্য রাজধানীসহ দেশের প্রধান তিনটি নগরীতে হেরেছে দলটি। তাই এই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের দল বিজয় দাবি করলেও পুরোপুরি আত্মতৃপ্তি যে পাচ্ছে না সেটি নিশ্চিত। ক্ষমতাসীন দলের জন্য এটি একটি শক্ত বার্তা। ২০০২ সাল থেকে এক ডজনের বেশি নির্বাচনে একক আধিপত্য ধরে রাখা দলটির জন্য এটি দেখা দেবে নতুন একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবেও।
যে কারণে তুরস্কের স্থানীয় সরকার নির্বাচন ভোটের আগেই আলোচনার জন্ম দিয়েছে তা হচ্ছে তুরস্ক নিয়ে বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমগুলোর আগ্রহ। দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষমতায় থাকা একে পার্টি এক দিকে পশ্চিমাদের জন্য অ্যালার্জি, অন্য দিকে উন্নয়নশীল ও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর কাছে রোল মডেল। তাই উভয়পক্ষই কঠোর নজর রাখে তুরস্কের দিকে; যে কারণে এই নির্বাচন নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা ছিল। আবার নির্বাচনের পর ভোটের ফলাফল, ভোট ফের গণনাসহ বিভিন্ন কারণেও বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। এসব যখন শেষ হয়েছে তখন শুরু হয়েছে ভোটের ফলাফল নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ।
বড় তিনটি নগরীতে বিরোধীদের বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে ইউরোপ ও আমেরিকার সংবাদমাধ্যমগুলো। বিষয়টি অবশ্য গুরুত্ব পাওয়ার দাবিও রাখে। কারণ যে তিনটি নগরীতে ক্ষমতাসীন দল হেরেছে সেগুলো হলো রাজধানী আঙ্কারা, সাবেক রাজধানী ও ঐতিহাসিক নগরী ইস্তাম্বুল ও ইজমির। এর মধ্যে আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুল অনেক দিন ধরেই (১৯৯৪) ছিল এ কে পার্টি নিয়ন্ত্রণে। কখনো একক, কখনো বা জোটের মাধ্যমে তারা এই নগর দু’টি নিয়ন্ত্রণ করেছে।
ইস্তাম্বুল তুরস্কের সবচেয়ে জনবহুল নগরী। ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তুরস্কের জাতীয় রাজনীতির লাইমলাইটে আসেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এর পর থেকে নগরীটি শাসন করেছে তার উত্তরসূরিরা। দীর্ঘ দিন দেশ শাসন করা এরদোগানের নিজের নগরী ইস্তাম্বুল সব সময়ই তাই পরিচিতি পেয়েছে এ কে পার্টির ঘাঁটি হিসেবে; কিন্তু এবার সেটি হাতছাড়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের। যদিও ভোটের ব্যবধান খুবই সামান্য। অন্য দিকে রাজধানী আঙ্কারাও ১৯৯৪ সাল থেকে শাসন করে আসছে এ কে পার্টি বা তার মিত্ররা; কিন্তু এবার এই দু’টি নগরী হাতছাড়া হয়েছে ক্ষমতাসীনদের। সামগ্রিকভাবে বিরোধীদের চেয়ে প্রাপ্ত ভোটের হার অনেক বেশি হলেও এটি তাই কপালে ভাঁজ আনতে বাধ্য এ কে পার্টির নীতিনির্ধারকদের। তুর্কি সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার এমরি গোনেন তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, এ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সরকারকে একটি শক্ত বার্তা দিতে চেষ্টা করেছে। যেটিকে তাদের গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। সরকারের জন্যও জনপ্রিয়তার একটি লিটমাস টেস্ট এই ভোট।
এবারের নির্বাচন যে এ কে পার্টির জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে সেটি সম্ভবত দলটির নেতারাও আগেই অনুমান করেছিলেন; যে কারণেই নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান স্বয়ং। দেশের প্রতিটি প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন তিনি। ফলও পেয়েছেন তার। সিরনাক, আগরি, মুস, বিতলিসের মতো কুর্দিপ্রধান শহরগুলোয় জিতেছে দল।
নির্বাচনে দলটির জন্য প্রধান ইস্যু ছিল অর্থনীতি। ২০০২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর এ কে পার্টির সরকারের সবচেয়ে সফল পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন। ঋণে জর্জরিত অর্থনীতিকে মেরামত করে স্বাবলম্বী করেছে এ কে পার্টির সরকার। তুরস্ক এখন বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ; কিন্তু সেই অর্থনীতিই এবার দলটির জন্য কিছুটা অস্বস্তিও বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মহামন্দা বাদ দিলে আর কখনোই অর্থনৈতিক সঙ্কট ছিল না তুরস্কের।
কিন্তু এক বছরেরও বেশি ধরে কঠিন সময় পার করছে তুরস্কের অর্থনীতি। ডলারের বিবরীতে অনেকাংশে কমেছে তুর্কি মুদ্রা লিরার দাম। এ সঙ্কটের কারণে কর্মসংস্থানেও দেখা দিয়েছে কিছুটা স্থবিরতা। সঙ্কট মোকাবেলায় কিছুটা যে হিমশিম খেয়েছে তুরস্ক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একের পর এক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এরদোগান সরকার বলছে, পশ্চিমা সরকারগুলোর অর্থনৈতিক কারসাজি তার দেশে সঙ্কটের মূল কারণ। পশ্চিমাদের সাথে তুরস্কের ঠাণ্ডা লড়াই চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন তুর্কি পণ্যে গত বছর শুল্ক বাড়িয়েছে বহুগুণ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অর্থনৈতিক সঙ্কটই এবারের নির্বাচনে বিরোধীদের ভোটের হার বৃদ্ধি করেছে। কাজেই এই সঙ্কট দূর করা তুরস্কের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এত দিন তুরস্কের ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল দু’টি- এক. পশ্চিমাদের সাথে চলা ঠাণ্ডা লড়াই কূটনৈতিকভাবে সামাল দেয়া, দুই. দেশে ও দেশের বাইরে সীমান্ত এলাকায় কুর্দিপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবেলা করা। যেটি দেশের স্থিতিশীলতা ও স্বার্বভৌমত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দু’টি বিষয় বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে এরদোগান সরকার।
পশ্চিমাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সংবিধান পরিবর্তন করে নির্বাহী প্রেসিডেন্সি চালু করেছে। রাশিয়ার সাথে সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও জোরদার করেছে আটলান্টিকের দুই পাড়ের বিরোধিতা উপেক্ষা করে। আবার কুর্দি উগ্রপন্থীদের দমনেও সফল হয়েছে; কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনে ভোটাররা যে বার্তা দিলেন সেটি সামলাতে হবে নতুন করে। এটিই এরদোগান ও তার দলের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুহিত্তিয়ান আতামান ডেইলি সাবাহয় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, (এই নির্বাচনের পর) সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত অথনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন। এমনকি পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
যদিও পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য অনেক সময় পাবে তারা। তুরস্কের আগামী জাতীয় নির্বাচন এখনো চার বছরেরও বেশি সময় দূরে। ২০২৩ সালে। পশ্চিমা সমালোচকেরা বলছেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আগামী নির্বাচনে এরদোগানের জনপ্রিয়তায় ধস নামাবে; কিন্তু ভঙ্গুর অর্থনীতিকে যারা শক্তিশালী করেছে সেই এ কে পার্টির সরকারের জন্য এটি অনেক সময়। আবার ক্যারিশমাটিক নেতা এরদোগানের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার বহু নজির রয়েছে। ২০১৩ সালে গাজী পার্ক আন্দোলনের পর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে এ কে পার্টি মোট ভোট পেয়েছিল এবারের চেয়েও কম। তখনো অনেকে বলেছিলেন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে দলটির পরাজয় হবে; কিন্তু দেখা গেছে প্রতিটি নির্বাচনেই জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে। তাই নতুন করে হাজির হওয়া এই মুদ্রাস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তারা সফল হবেন সেটি অনুমেয়। এরই মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারেও কাজ চলছে ব্যাপকভাবে। ২০০৯ সালের মহামন্দার পরের নির্বাচনেও এ কে পার্টি ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল; যা দলটির জনপ্রিয়তা ধরে রাখার ক্ষমতারই প্রমাণ।