বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছররা গুলিতে ৪০১ জনের চোখ নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জন দুই চোখেরই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এক চোখ নষ্ট হয়েছে ৩৮২ জনের। এ ছাড়া ২ জনের দুই চোখে ও ৪২ জনের এক চোখে গুরুতর দৃষ্টিস্বল্পতা দেখা দিয়েছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গত ১৭ জুলাই থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত চোখে আঘাত নিয়ে ৮৫৬ জন ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাঁদের মধ্যে ৭১৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। চোখে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে ৫২০ জনের।
গুলিতে দুই চোখের দৃষ্টি হারানোদের মধ্যে ছয়জন শিক্ষার্থী। বাকিদের মধ্যে শ্রমিক, গাড়িচালক ও চাকরিজীবী দুজন করে ছয়জন। একজন শিক্ষক। অন্য ছয়জনের পেশাগত পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ৫৭৯ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে ৫৫৮ জন পুরুষ ও ২১ জন নারী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ৫৭৯ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে ৫৫৮ জন পুরুষ ও ২১ জন নারী।
রাকিবুল ইসলাম ৩ সেপ্টেম্বর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, গুলি লাগার পর তাঁর দুই চোখে একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে। বাঁ চোখের সামনে এক ফুটের মধ্যে হাতের নড়াচড়া আন্দাজ করতে পারলেও ডান চোখে পুরোপুরি ঝাপসা দেখেন বলে জানালেন।
চোখে গুলি লাগার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাকিবুল বলেন, ‘আমরা সড়কে অবস্থান নিয়েছিলাম। হঠাৎ সেখানে পুলিশ এসে প্রথমে সাউন্ড গ্রেনেড মারতে শুরু করে। একপর্যায়ে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছররা গুলি ছুড়তে শুরু করে। এ সময় আমার চোখে গুলি লাগে।’
রাকিবুল ইসলাম জানান, মূল সড়কে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছররা গুলি ছুড়ছিল পুলিশ। আর ভেতরের দিকে শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা করছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে দুই চোখ হারিয়েছেন নির্মাণশ্রমিক দেলোয়ার হোসেন। তিনি থাকেন উত্তরার দেওয়ানবাড়ীর জয়নাল মার্কেট এলাকায়। গত ২০ জুলাই সন্ধ্যার পর খিলক্ষেত থেকে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে আজমপুর রেলক্রসিং এলাকায় তাঁর দুই চোখে গুলি লাগে।
দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আজমপুর রেলক্রসিংয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছিল। হঠাৎ তাঁর সামনে কাঁদানে গ্যাসের একটি শেল পড়লে চোখে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। একটু স্বাভাবিক হয়ে যখন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন, তখনই পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি চোখে ও মুখে লাগে। দৌড়ে পালানোর সময় পিঠেও আরও কয়েকটি ছররা গুলি লাগে বলে জানান তিনি।
দেলোয়ারের স্ত্রী হালিমা বেগম প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের তিন মেয়ে আছে। বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, বাকি দুজন মাদ্রাসায়। নিজে একটি বাসায় অস্থায়ী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। মাসে পারিশ্রমিক পান ৪ হাজার টাকা। স্বামী চোখে আঘাত পেয়ে দেড় মাস ঘরে বসে থাকায় থাকা-খাওয়া চালাতে কষ্ট হচ্ছে।
হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় চোখে আঘাত পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী ৬৩ জন। এর মধ্যে চারজনের বয়স ১০ বছরের কম।
গত ২১ জুলাই দুপুরে রাজধানীর বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় দাদা মোহাম্মদ তোজাম্মলের সঙ্গে তাঁর চা–দোকানে ছিল দুই বছর তিন মাস বয়সী শিশু তানিয়া। দোকানের সামনে পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি লাগে তানিয়ার চোখে। গুলিতে বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে শিশুটি। ওই চোখ দিয়ে সে এখন শুধু এক ফুটের মধ্যে হাতের নড়াচড়া বুঝতে পারে।
মুঠোফোনে কথা হয় তানিয়ার দাদা চা-দোকানি মোহাম্মদ তোজাম্মলের সঙ্গে। তিনি জানান, চোখে গুলি লাগার পর অনেক জায়গায় গিয়ে চিকিৎসা করিয়েও তানিয়ার বাঁ চোখের দৃষ্টি ফেরানো যায়নি।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তোজাম্মল বলেন, ‘সেদিন দুপুরের ঘটনা। তানিয়া আমার দোকানের সামনে বসে ছিল। পুলিশ প্লাজার দিক থেকে কয়েকটি গাড়িতে করে সেখানে আসে একদল পুলিশ। দোকানের সামনে দিয়েই গাড়িগুলো যায়। পেছনের গাড়িটি আমার দোকান থেকে ২০-২৫ হাত দূরে যাওয়ার পরে হঠাৎ গুলি করতে শুরু করে। হঠাৎ দেখি আমার নাতির চোখ থেকে রক্ত পড়ছে, তার কপালটাও ফুলে গেছে।’ সেখানে ওই সময় কোনো আন্দোলনকারী ও বিক্ষোভ চলছিল না বলেও জানান তিনি।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সোমবার পর্যন্ত ওই হাসপাতালে মোট ৫৩ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালের পরিচালক খায়ের আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে অন্তত তিনজন এখনো দুই চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। এর বাইরে অনেকের এক চোখের অবস্থা খুবই খারাপ।’ প্রথম আলো প্রতিবেদন