মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪
ফারজানা ইয়াসমিন। গাজীপুরের টঙ্গী চেরাগ আলী এলাকার বাসিন্দা। চলতি বছরের ১০ই মে পাশের বাসার কাকলী বেগমের কাছ থেকে এমটিএফই অ্যাপের বিষয় জানতে পারেন। যে অ্যাপে ২৫ হাজার টাকা ইনভেস্ট করলে মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করার সুযোগ আছে। এমন কথা শুনে স্বল্প সময়ে স্বাবলম্বী হওয়ার আগ্রহ তৈরি হয় তার মধ্যে। পরে স্বামীকে না জানিয়ে স্থানীয় এক এনজিও থেকে ২৫ হাজার টাকা লোন নিয়ে কাকলীর মাধ্যমে এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেন ইয়াসমিন। বিনিয়োগের পর দুই মাস ভালোই চলছিল। লাভের টাকা বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণ হওয়ায় টাকা তোলার চিন্তাও করেননি ইয়াসমিন। দুই মাসে ২৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকা হয়ে যায়। কমিশন পেতে ও আয়ের পরিমাণ বাড়াতে নিকট আত্মীয়দের অনেককেই এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত করেন।
দেড় মাসে ইয়াসমিন প্রায় ১৫ জনকে যুক্ত করেন এ প্ল্যাটফরমে। কিন্তু গত ১৭ই আগস্ট রাতে সকলের টাকা উধাও (স্ক্যাম) করে কানাডাভিত্তিক কোম্পানিটি। এতে নিজের টাকা তো গেছেই অন্যের টাকার চাপে দিশাহারা ইয়াসমিন। শুধু ফারজানা ইয়াসমিন একাই নন, দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ছে এমটিএফই গ্রাহকদের লোভনীয় আশ্বাস দিয়ে ফকির করে পালিয়ে গেছে কোম্পানিটি। কেউ কেউ টাকা খুইয়ে এখন পাগলপ্রায়। চারদিকে আহাজারি। টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক গ্রুপগুলোতে এমন চিত্র দেখা গেছে। নাবিল হোসেন নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, এমটিএফই’র গ্রুপগুলোতে কান্নার রোল পড়েছে। যেন সবাই হাহাকার করছে। টাকা হারিয়ে অনেকে জ্ঞান হারিয়েছেন। সবাই কপাল চাপড়াচ্ছেন। কেউ কেউ চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসারদের (সিইও) কাছে কান্নাকাটি করছে। গ্রুপে অনেকে বলছেন, তারা ধারদেনা ও ঋণ করে টাকা ইনভেস্ট করেছেন। কেউ পালের গরু ও জমি বিক্রি করেও এই অ্যাপে ইনভেস্ট করেছে। এখন ঋণের টাকা কীভাবে দেবেন সেই চিন্তা করছেন। এমটিএফই এভাবে প্রতারণা করবে কেউ চিন্তাই করেনি! সিইওরা একদিন বলছিলেন এমটিএফই’র কানাডা সরকার থেকে লাইসেন্স নেয়া আছে। অস্ট্রেলিয়ার ব্রোকার লাইসেন্স নেয়া আছে। তারা টাকা মেরে যেতে পারবে না। কিন্তু এখন গ্রুপ বন্ধ করে সিইওরাই পালিয়েছে। তাদের ফোনও বন্ধ।
জানা গেছে, কানাডিয়ান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ কোম্পানি (এমটিএফই) বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ২০২১ সালে। তিন বছরে এমটিএফইতে শুধু বাংলাদেশ থেকেই ৪২ লাখ মানুষ যুক্ত হয়েছেন। প্রাথমিক অবস্থায় এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত প্রত্যেকেই ৬১, ২০১, ৫০১, ৯০১ ও ২ হাজার ডলার ডিপোজিট করেন। বেশি টাকা আয় করতে কেউ কেউ ৫ হাজার ডলারের বেশিও ইনভেস্ট করেছেন। এভাবে কোম্পানিটি গ্রাহকদের কাছ থেকে ২ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে কোম্পানিটির ৪ শতাধিক অফিস রয়েছে। এমটিএফই’র অ্যাপে এসব অফিসের ছবিসহ ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য দেয়া আছে। মূলত দুবাই থেকে মাসুদ আল ইসলাম নামের এক বাংলাদেশি এমটিএফই’র এশিয়া অঞ্চলের দেখভাল করেন। তিনিই এমটিএফই’র কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন গ্রুপগুলোতে ছড়িয়ে দিতেন। তার থেকে পাওয়া তথ্য অন্যান্য গ্রুপের সিইওরা তাদের মেম্বারদের জানাতেন। মেম্বাররা আবার তাদের সদস্যদের জানাতেন।
এমটিএফই মূলত এমএলএম কোম্পানির মতো তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে। প্রথম হাত, দ্বিতীয় হাত, তৃতীয় হাত পর্যন্ত আয়ের টাকা ভাগাভাগি হতো। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশে এমটিএফই কোম্পানিটির প্রায় সাড়ে ৩ শতাধিক সিইও আছে। এমটিএফইতে নিজের প্রমোকোড ব্যবহার করে মানুষকে যুক্ত করতে পারলেই এমটিএফই তাকে সিইও হিসেবে প্রমোশন হয়। পরে এমটিএফই কোম্পানি প্রত্যেক সিইওকে প্রতিমাসে ৩ লাখ টাকা বেতন ও ১ লাখ টাকা অফিস ভাড়া প্রদান করে। সিইওদের প্রধান কাজ ছিল বিপুল অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে কোম্পানিতে হাজার হাজার মানুষকে যুক্ত করা। এতে তারা সফলও হয়। সহজেই লাখ লাখ মানুষকে যুক্ত করতে পেরেছে। প্রতিজন সিইওর আন্ডারে প্রায় ১ থেকে দেড় লাখ মানুষ এমটিএফইতে যুক্ত রয়েছে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা টেলিগ্রাম ও হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। গ্রুপে সদস্যদের ট্রেডিংয়ের সিগন্যাল দেয়া হতো। সেই সিগন্যাল অনুযায়ী গ্রাহকরা এমটিএফইতে ট্রেড করতো। ওই গ্রুপে এমটিএফই’র নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধার কথা জানানো হয়। এই সিইওদের মাধ্যমে টিম গঠন করে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিমাসে ২ থেকে ৩ শতাধিক সেমিনার আয়োজন করা হয়। মূলত অ্যাপে সদস্য বাড়াতেই এই সেমিনার করা হয়। যারা আগে থেকেই অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের মাধ্যমে শত শত মানুষকে এই সেমিনারে আনা হতো। সেমিনার শেষে খাবারেরও ব্যবস্থা করা হতো। ঢাকার সেমিনারগুলো ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, মোহাম্মদপুর, মহাখালি, উত্তরা, মিরপুরের বিভিন্ন নামিদামি রেস্টুরেন্টে আয়োজন করা হতো। সিইওদের অফিসগুলোও এসব এলাকায়। সেমিনার থেকে সিইওরা সাধারণ মানুষকে ভাগ্য পরিবর্তনের নানা মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। অনেকে সেমিনার থেকেই অ্যাপ ইনস্টল করে এমটিএফইতে যুক্ত হতেন। ধারদেনা করে ডলার ঢুকাতেন। এবং সদস্য সংগ্রহ করতে নেমে পড়তেন। তাদেরও সিইও হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমটিএফই’র এক সিইও বলেন, সদস্য বাড়াতে এমটিএফই এমএলএম কোম্পানির মতো কমিশন ব্যবস্থা চালু করে। এতে একজন যুক্ত হলে তার মাধ্যমে যতজন যুক্ত হবে সবার থেকেই মোটা অঙ্কের কমিশন পেতেন প্রথম ব্যক্তি। প্রথম ব্যক্তি এমটিএফইতে ট্রেড করলে তার আয় থেকে একটি অংশ প্রতিদিনই প্রথম হাত, দ্বিতীয় হাত ও তৃতীয় হাত পর্যন্ত কমিশন আকারে দেয়া হয়। এতে যত বেশি সদস্য তত বেশি কমিশন। এই লোভেই অনেকে পাগলের মতো হন্যে হয়ে মেম্বার যুক্ত করতে থাকে। অনেকে কমিশন দিয়েই কোটিপতি হয়েছেন। তবে শুরু থেকে যারা আছেন তারা সবাই লাভবান। নতুন যারা যুক্ত হয়েছেন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। টাকা ফেরত আনার কোনো রাস্তা নেই। কাস্টমার কেয়ার এখন মেসেজের উত্তর দেয় না।
কোম্পানিটির ওয়াবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, তারা ২০১৬ সালে কানাডা সরকার থেকে সরকারি এমএসবি লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে তারা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সরকার থেকে ফিনট্রেক লাইসেন্স নেন। এই দুটি লাইসেন্সের পিডিএফ কপি ও ছবি দিয়ে প্রচারণা চালায়। অনলাইনে দেখা যায় এমটিএফই একটি অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফরম। ক্রিপ্টোকারেন্সির অনলাইনভিত্তিক ব্রোকার কোম্পানি ফরেক্স, ইনডেক্স ও কমোডিটিতে ট্রেডের নামে এমটিএফই গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। তবে এসব ব্রোকার হাউজের ওয়েবসাইটকে এমটিএফই তাদের সঙ্গে ট্রেডিং করে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এমটিএফই মূলত অর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এআই ট্রেডিংয়ের নামে গ্রাহকদের সঙ্গে ৩ বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিলেন। এই এআই দিয়ে মাঝেমধ্যেই গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টের ডলার গায়েব করে দেয়া হতো।
যেভাবে লাপাত্তা এমটিএফই: একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমটিএফই গত ৭ই আগস্ট থেকে টেকনিক্যাল সমস্যা দেখিয়ে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন সেবা বন্ধ করে দেয়। এরপরে গ্রাহকদের সঙ্গে কাস্টমার সার্ভিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে কোম্পানিটি। পরে কাস্টমার সার্ভিস থেকে জানানো হয় সফটওয়্যার আপগ্রেডের কারণে আপাতত উত্তোলন সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। একটি নোটিশ দিয়ে এ তথ্য জানানো হয়। তবে এরপরে ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও তাদের সফটওয়্যার আপগ্রেড শেষ হয়নি। উল্টো ৭ তারিখের আগে গ্রাহকদের উইথড্রো দেয়া সব ডলার রিজেক্ট করে পুনরায় অ্যাকাউন্টে ফেরত নিয়ে যায়। আবার নোটিশ দিয়ে জানানো হয় সফটওয়্যার আপগ্রেডের কাজ নির্বিঘ্নে করতে সকলের লেনদেন বাতিল করা হয়েছে। তবে গত ১৭ তারিখে এমটিএফই তাদের অ্যাপে প্রবেশ বন্ধ করে দেন। নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও গ্রাহকরা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এআই বাটন অন করতে পারেনি। পরে ওইদিন রাত ৮টার পরে কোম্পানিটি গ্রাহকদের অনুমতি ছাড়াই এআই বাটন অন করে দেন।
এদিন রাত ১২টার পরে ট্রেডিংয়ের নামে সকলের অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেয়া হয়। উল্টো গ্রাহকদের মূলধনের অর্থের সমপরিমাণ ডলার মাইনাস করে দেখানো হয়। এবং তাদের অ্যাপে জরুরি নোটিশ জারি করা হয়। নোটিশে বলা হয়, গ্রাহকরা এমটিএফই সেবা চলমান রাখতে হলে তাদের মাইনাস ব্যালেন্স পরিশোধ করে আবার ডলার ডিপোজিট করুন। এমনকি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এমটিএফই’র প্রাপ্ত মাইনাস ডলার পরিশোধ না করলে গ্রাহকদের আইনি নোটিশ পাঠানোর হুমকি দেয়া হয়। শুধু বাংলাদেশই নয় এমটিএফই তাদের কার্যক্রম পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়। কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া, ইসরাইল, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, কেনিয়া, তানজেনিয়া, রুয়ান্ডা, কঙ্গো, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ওমান, আইভোরিকোস্ট, ইরাক, ইয়েমেন ও জিবুতিতে তারা প্রতারণা করে প্রায় ৭ কোটি মানুষের কাছ থেকে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার নিয়ে উধাও হয়েছে।
জানতে চাইলে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ মানবজমিনকে বলেন, এমটিএফই নামের একটি কোম্পানি মানুষের টাকা নিয়ে স্ক্যাম করেছে বিষয়টি আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। তবে এখনো কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে কোন নাম্বারে টাকা পাঠিয়েছে সেই নাম্বারে খোঁজ করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। মানব জমিন প্রতিবেদন