শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোতে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বাতিল

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি চেয়ে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল রাশিয়া, তা বাতিল করেছে জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদ। সোমবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জাতিসঙ্ঘের নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন। নেবেনজিয়ার উত্থাপিত সেই প্রস্তাবে গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ইসরাইল ও ফিলিস্তিনে বেসামরিক লোকজনকে হত্যার নিন্দা জ্ঞাপনের পাশাপাশি হামাসের হাতে আটক ইসরাইল ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মুক্তি, মানবিক সহায়তা করিডোর গঠন এবং বেসামরিকদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য সেফ প্যাসেজের দাবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এএফপি।
সোমবারের বৈঠকে প্রস্তাবটি উত্থাপনের পর নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী-অস্থায়ী ১৫ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে চারটি রাষ্ট্র এটির পক্ষে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অপর চারটি রাষ্ট্র এর বিপক্ষে ভোট দেয়; আর ভোটদান থেকে বিরত থাকেন বৈঠকে উপস্থিত অপর ছয় সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ ছিল নিরাপত্তা পরিষদের সোমবারের বৈঠকের মূল ইস্যু। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধি কূটনীতিকরা জানিয়েছে, বৈঠকে রাশিয়ার পাশাপাশি ব্রাজিলও এই ইস্যু সংক্রান্ত খসড়া একটি রেজোল্যুশন উত্থাপন করেছে এবং সেটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি। ব্রাজিলের সেই রেজোল্যুশনে এই হামালার জন্য হামাসকে নিন্দা জানানো হয়েছে।
কূটনীতিকরা আরো জানিয়েছেন, গতকাল মঙ্গলবার প্রস্তাবটি চূড়ান্ত আকারে পরিষদের বৈঠকে তোলার কথা রয়েছে। সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ভোটের পর জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ‘আমাদের রেজোল্যুশন পাস হয়নি, তবে এর মধ্যে দিয়ে এই যুদ্ধ নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সক্রিয় হলো নিরাপত্তা পরিষদ। যদি আমরা উদ্যোগ না নিতাম, সে ক্ষেত্রে সবকিছুই কেবল আলাপ-আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত।’
ভোটপর্বে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রুশ প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেয় পরিষদের অন্যতম স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য। এই পর্ব শেষ হওয়ার পর জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড রাশিয়ার সমালোচনা করে বলেন, সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সাথে আলোচনা না করেই এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছে রাশিয়া এবং এই প্রস্তাবে যুদ্ধের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে ঐকমত্য গঠনের ব্যাপারটিকেও হালকাভাবে নেয়া হয়েছে।
‘আমরা এমন কোনো রেজোল্যুশনকে সমর্থন করতে পারি না, যা হামাসের সন্ত্রাসী হামলাকে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়,’ বলেন বারবারা উডওয়ার্ড। জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান বলেন, ‘যেকোনো প্রকার মানবিক সহায়তা, যুদ্ধবিরতি বা শান্তি স্থাপনের আগে নিরাপত্তা পরিষদের উচিত হবে হামাসের নিন্দা জানানো।’

গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত আরো ৭১
এদিকে গাজা ভূখণ্ডে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এর মধ্যে সর্বশেষ এক হামলায় ৭১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো বহু মানুষ। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা ইসরাইলি হামলায় গাজায় সামগ্রিকভাবে নিহতের সংখ্যা ২৮০০ ছাড়িয়েছে। মঙ্গলবার এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
খবরে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরাইলের আরেকটি বিমান হামলার পর প্রাথমিকভাবে প্রথমে ২৫ জনের ও পরে ৫৪ জনের নিহত হওয়ার কথা বলা হলেও পরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭১ জনে পৌঁছেছে। গাজার একটি মেডিক্যাল সূত্র আল জাজিরা আরবিকে জানিয়েছে, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের দক্ষিণ অংশের একটি বাড়িতে ইসরাইল বিমান হামলা চালায়। আর সেখানেই হতাহতের এই ঘটনা ঘটে।
অবশ্য দক্ষিণ গাজার কোন অংশে ইসরাইলি এই হামলা হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। এর আগে, গাজার খান ইউনিস এবং রাফাহ এলাকায় লাগাতার বোমা হামলার খবর পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছে আলজাজিরা। ওই মেডিক্যাল সূত্র আরো জানিয়েছে, রাফাহ এবং খান ইউনিসের বাড়িগুলোকে লক্ষ্য করে বোমা হামলায় আরো কয়েক শ’ মানুষ আহত হয়েছেন। এ ছাড়া পৃথক এক বিবৃতিতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা রাতের আঁধারে গাজা উপত্যকায় হামাসকে লক্ষ্য করে ২০০ টিরও বেশি হামলা চালিয়েছে। গাজার উত্তরাঞ্চলেও ইসরাইলের ভারী গোলাবর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। আলজাজিরা বলছে, উত্তর গাজা উপত্যকার কিছু এলাকায় ইসরাইলের ভারী গোলাবর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে হতাহতের বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া সোমবার রাত এবং মঙ্গলবার ভোরের দিকে ইসরাইল যেসব বোমা হামলা চালিয়েছে তার বেশির ভাগই দক্ষিণ গাজাকে কেন্দ্র চালানো হয়।
দক্ষিণ গাজায়ও রক্ষা নেই ফিলিস্তিনিদের : ইসরাইলের নির্দেশে উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ গাজায় গিয়েও রক্ষা পাচ্ছেন না ফিলিস্তিনিরা। সেখানেও হামলা করছে ইসরাইলিরা। তাদের হামলায় দক্ষিণ গাজায় নিহত অনেকেই উত্তর গাজা থেকে আসা শরণার্থী। এ বিষয়ে দক্ষিণ গাজায় আসা এক ফিলিস্তিনি শরণার্থী বলেন, ‘আমি গাজার দক্ষিণের খান ইউনিসে আছি। এটি সেই এলাকা যেখানে ইসরাইল গাজা সিটি এবং তার উত্তরে বসবাসকারী প্রায় ১১ লাখ লোককে আসতে বলেছে। এখানে রাতারাতি যেসব ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে তাতে অধিকাংশ ফিলিস্তিনিই উদ্বিগ্ন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘তিনটি ইসরাইলি বিমান হামলায় শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তাদের অধিকাংশই গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে আসা উদ্বাস্তু।

লড়াই হামাসের সাথে, ফিলিস্তিন নয় : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যে অভিযান পরিচালনা করছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ), তা পুরোপুরি হামাসের বিরুদ্ধে। সাধারণ বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরাইলের কোনো ক্ষোভ নেই বলে দাবি করেছেন এই ভূখণ্ডের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সোমবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহুর পক্ষে তার মুখপাত্র তাল হেইনরিশ এই দাবি করেন। হেইনরিশ বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইসরাইলের লড়াই হামাসের বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিন বা সেখানকার সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে নয়।’
বন্দীদের মুক্তিতে হামাসের শর্ত : ইসরাইলের ২০০ জনের বেশি লোককে বন্দী করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ইসরাইলও জানিয়েছে হামাসের হাতে গাজায় তাদের অন্তত ১৯৯ জন বন্দী রয়েছে। এবার এসব বন্দীর মুক্তির জন্য শর্ত দিয়েছে হামাস। হামাসের একজন শীর্ষ নেতা সোমবার বলেছেন, ইসরাইলের কারাগারে থাকা সব ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিলে ইসরাইলি বন্দীদের ছাড়া হবে। এ সময় তিনি ইসরাইলি বন্দীদের মেহমান হিসেবে উল্লেখ করেন। গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে আক্রমণ করে। এরপর ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ বহু লোককে বন্দী করে গাজায় নিয়ে যায়। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলছে, গাজায় ১৯৯ জনকে বন্দী করে রেখেছে হামাস। অপরদিকে হামাস বলেছে যে, তাদের হাতে ২০০ থেকে ২৫০ ইসরাইলি বন্দী রয়েছে। হামাসের সাবেক প্রধান খালেদ মেশাল বর্তমানে দোহায় তাদের প্রবাসী অফিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইসরাইলের কারাগারে ছয় হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দী রয়েছে। তাদের সবার মুক্তি চায় হামাস।
সোমবার হামাস একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে বন্দীদের একজন ফ্রাঙ্কো-ইসরাইলি মহিলার একটি বিবৃতি দেখানো হয়েছে। তাকে গত সপ্তাহের হামলায় আটক করা হয়েছিল। হামাসের সামরিক শাখার মুখপাত্র আবু ওবায়দা এক ভিডিওবার্তায় বলেছেন, হামাসের হাতে বিভিন্ন জাতীয়তার একদল বন্দী রয়েছে।

তারা আমাদের অতিথি এবং আমরা তাদের রক্ষা করতে চাই। তিনি বলেন, পরিস্থিতি বুঝে আমরা বিভিন্ন জাতীয়তার বন্দীদের মুক্তি দেবো। হামাসের আরেক সিনিয়র কর্মকর্তা মুসা আবু মারজুক সোমবার বলেছেন যে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের অব্যাহত বোমা হামলার কারণে বিদেশী বন্দীদের মুক্তি দেওয়া যাচ্ছে না।
২০০০ সেনা পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র : ইসরাইল-হামাস সঙ্ঘাতে ইরান কিংবা হিজবুল্লাহর মতো শক্তিগুলো জড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ইসরাইলি নৌসীমার কাছে দুই হাজার সৈন্য মোতায়েন করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির দুই প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা সিএনএনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তারা জানিয়েছেন, দুই হাজার মেরিন ও নাবিক নিয়ে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রের র‌্যাপিড রেসপন্স ফোর্সকে ইসরাইলের নৌসীমার কাছে পাঠানো হচ্ছে। ইসরাইলকে পাহারা দিতে এর আগে পাঠানো একাধিক রণতরী ও যুদ্ধজাহাজের সাথে যোগ দেবে সঙ্ঘাত মোকাবেলায় দক্ষ এই বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকে ইরান ও তাদের সমর্থিত হিজবুল্লাহর প্রতি কড়া সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। কয়েকজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, রোববার সন্ধ্যায় মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন প্রায় দুই হাজার সৈন্যকে ইসরাইলে সম্ভাব্য মোতায়েনের জন্য প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন। এসব সৈন্য চিকিৎসা এবং লজিস্টিক কাজে ইসরাইলিদের সহায়তা করতে পারবে।
বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ প্রতিরোধের লক্ষ্যে এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। তবে এর মাধ্যমে সঙ্ঘাতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আরো বেড়েছে বলে উল্লেখ করেছেন তারা। যদিও বাইডেন প্রশাসন বলছে, তারা সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ এড়ানোর চেষ্টা করছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসরাইল-হামাস সঙ্ঘাতের জেরে ইসরাইলি ভূমিতে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই যুক্তরাষ্ট্রের।
হুমকিতে ভীত নয় হামাস : হামাসের সামরিক শাখার মুখপাত্র আবু ওবায়দা বলেছেন, ‘অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের স্থল আক্রমণের হুমকিতে আমরা ভীত নই। আমরা এর জন্য প্রস্তুত আছি।’ স্থানীয় সময় সোমবার ফিলিস্তিনি একটি টেলিভিশনে আবু ওবায়দার বক্তব্য প্রচারিত হয়। এতে এই হামাস নেতা বলেন, ‘৭ অক্টোবর ইসরাইলের দক্ষিণে ব্যাপক আক্রমণের পর থেকে ইজ্জুদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড ২০০ জনকে বন্দী করে রেখেছে।
আরো প্রায় ৫০ জনকে অন্যান্য প্রতিরোধ দল বিভিন্ন জায়গায় বন্দী করে রেখেছে। আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে স্থল আক্রমণ চালানোর যে হুমকি দখলদারেরা (ইসরাইল) দিয়েছে, তাতে আমরা ভীত নই। আমরা এর জন্য প্রস্তুত আছি।’

আরো পড়ুন ...