শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
বিবিসি প্রতিবেদন: গত কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশে তীব্র লোডশেডিংয়ে নাকাল মানুষ। ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন কমেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। একইসাথে জ্বালানির আমদানি নির্ভর এ খাতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে সরকারের বকেয়াও বাড়ছে। ফলে চাহিদা মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না।
দেশে বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কম।
শেখ হাসিনা সরকার গত পনের বছরে দেশে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে।
জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করে অপরিকল্পিতভাবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। অনেক ক্ষেত্রে চাহিদাও বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকার অর্থনৈতিক যে বিপর্যয় রেখে গেছে তারই ফলশ্রুতিতে এই পুরো খাত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।
ফলে অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। সম্পূর্ণ টাকা দেয়া সম্ভব না হলেও যতটুকু টাকা দিয়ে সরবরাহ বজায় রাখা যায় ততটুকু দিতে হবে।
এদিকে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, সাময়িক সংকট সমাধানে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ডলার পেমেন্ট করা হচ্ছে।
এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের মূল সমস্যা ডলার সংকট। একে কেন্দ্র করেই অন্য সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করেছে এই মুহূর্তে।
একইসাথে বিগত সরকারের অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নের খেসারত দিতে হচ্ছে জনগণকে।
দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ আসে গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে।
গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় বারো হাজার মেগাওয়াট। আগে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে।
অথচ এখন পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ খাত দিনে ১২০ থেকে ১৩০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে। এখন ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ হচ্ছে বলে জানিয়েছে পিডিবি।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে দিনে গ্যাস আসে একশ দশ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭শে মে থেকে বন্ধ। ফলে এখন সরবরাহ হচ্ছে ৬০ কোটি ঘনফুট।
যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব ইউনিট। ফলে গতকাল মঙ্গলবার তিন হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি লোডশেডিং ছিল।
ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। দিনে দেড় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল। কিন্তু বকেয়া পরিশোধ না করায় এখন এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে তারা।
শেখ হাসিনার সরকার ব্যাংক থেকে বন্ড ছেড়ে বেসরকারি খাতের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল কিছুটা কমাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের এখনও অনেক বকেয়া রয়েছে।
গ্যাস বিল, সরকারি–বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল, ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল সব কিছু মিলিয়ে পিডিবির বকেয়া টাকার পরিমাণ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বকেয়া অর্থ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ভারতের আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, “এখন অন্যতম প্রধান সমস্যাই অর্থ সংকট। তাই অন্য খাতে কমিয়ে এখানে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হবে। তেল-চালিত কেন্দ্রগুলো বেশি চালাতে হবে। ডলার জোগাড় করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। ১৫ শতাংশ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গ্যাস রেশনিং করতে হবে। তবেই লোডশেডিং এর সংকট সমাধান হতে পারে।”
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ খাতে পলিসিগত যে ভুল সবচেয়ে ভয়াবহ হয়েছে সেটা হলো পুরো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা শক্তিশালী অর্থনীতির বিবেচনায় আমদানি নির্ভর করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনার সরকার অর্থনীতির একটি ভ্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গ্যাসের পাশাপাশি তেল ও কয়লার ব্যবহার বেড়েছে।
এই জ্বালানির বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর আগে সরকার কখনো নিজেরা প্রাথমিক জ্বালানির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। অথবা বিকল্প জ্বালানি হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে গুরুত্ব দেয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জ্বালানির এই আমদানি নির্ভরতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। যা সরাসরি ডলারের ওপর চাপ তৈরি করেছে।
আমদানি নির্ভরতার সংকটের দৃষ্টান্ত হিসেবে ২০২২-২৩ সালকে উল্লেখ করছেন বিশ্লেষকরা। জ্বালানি আমদানির জন্য অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয় ওই বছর।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বাকিতে দিচ্ছে। তারা নিজের খরচে জ্বালানি ক্রয় করছে। কিন্তু ফুয়েল এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের টাকাতো তাদের বাকি পড়ছে।
এ খাতের সংকট নিরসনে সরকারকে অগ্রাধিকার-ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে বলে মনে করেন মি. আলম। যতটুকু অর্থ দিয়ে সরবরাহ বজায় রাখা যায় তা দিতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এ খাতকে চরম অব্যবস্থাপনার খাত হিসেবে অভিহিত করেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের হিড়িক পড়ে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন পাস করে এগুলোকে দায়মুক্তি দেয়া হয়। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়াই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।
ব্যবসায়ীরা ছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতারাও বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা নেন।
অনেক পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করা হলেও সেগুলো থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ অর্থের অভাবে গ্যাস ও তেল কেনা যাচ্ছে না। এরকম বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি স্থগিত বা রিনিউ করা হয়নি।
দেশের দক্ষিণে চারটি বড় বড় কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো পায়রা, রামপাল, এস আলম এবং মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ লাইন না থাকার কারণে এগুলো থেকে বিদ্যুৎ ঢাকার দিকে আনা যাচ্ছে না। অথচ তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়।
তারা বলছেন, এখন ক্যাপাসিটির অসুবিধা নেই। কিন্তু সরবরাহ লাইনের সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
৬০ শতাংশ জ্বালানি আমদানি করার কারণে এই সেক্টর বেশি প্রভাবিত বলে জানান জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিশেষজ্ঞ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “চুক্তিটা নিয়ে অনেক কথা হতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে আদানির সরবরাহ যদি বন্ধ হয়ে যায় তবে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কথা হচ্ছে যে আদানি আটশ মিলিয়ন ডলার পাবে এটাতো তার চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্য। এখন আমরা যদি না দিতে পারি টাকাটা, ওরা কতদিন বাকিতে বিদ্যুৎ দেবে?”
“আদানিরা বলেছে পাঁচশ মিলিয়ন ডলারের উপরে বকেয়া হলে এটা সাসটেইনেবল না। তারা পাঁচশ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রানিং বিল বাকি রাখতে রাজি আছে। আসলে চুক্তি অনুযায়ী সেটাও থাকতে পারে না। কিন্তু তারা এগ্রি করেছে। এর উপরে হলেতো…. তাদেরও কয়লা আমদানি করতে হয়, লজিস্টিক, মেইনটেনেন্স কস্ট আছে। তাই না?” যোগ করেন তিনি।
যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন বন্ধ আছে। একইসাথে আদানির কেন্দ্র থেকেও বিদ্যুতের সরবরাহ কমানো হয়েছে।
জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “বড়পুকুরিয়াতে একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। সেখানেও একটা যান্ত্রিক ত্রুটি হয়েছে। সেটাও আমরা আশা করতেছি ১৮ তারিখের মধ্যে চলে আসবে।”
“এছাড়া আদানি থেকে যে আমরা বিদ্যুৎ আনি, সেখানেও একটু সরবরাহ কমে গেছিল। এটা যোগাযোগ করা হয়েছে। এবং সেটা আবার পুনরায় বেড়ে গেছে। সেজন্য গত পরশুর তুলনায় গতকাল বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভালো ছিল।”
বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতির প্রধান কারণ গ্যাসের অভাব এ কথা উল্লেখ করে মি. খান বলেন, “সামিটের এফএসআরইউটা সাড়ে তিন মাস ধরে বন্ধ ছিল। সেটা এখন ঠিক হয়েছে। আমরা এখন নতুন গ্যাসের অর্ডার দিয়েছি।”
“আজকেই এটার জন্য টেন্ডার করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া শেষ করে ধরেন তিন সপ্তাহের মধ্যে গ্যাস আসবে। তাহলে পাঁচশ এমসিএফডি গ্যাস যুক্ত হবে। তখন আমরা আনুপাতিক হারে বিদ্যুতের জন্য বেশি গ্যাস পাবো।”
এর ফলে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন জ্বালানি উপদেষ্টা।
গত তিন দিনে লোডশেডিংয়ে যে পরিস্থিতি হয়েছে সেটা আর হবে না বলে জানান মি. খান। সাময়িক সংকটে ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
“এমনে সার্বিক উন্নতির জন্য এফআরএসইউটা চালু করা হয়েছে ১০ তারিখ থেকে। এখন এটা না থাকলে তো গ্যাস আনতে পারতাম না। এজন্য ক্রয় কমিটিতে আলাপ করেছি। আজকেই টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে,” বলেন মি. খান।
এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ছয় সাতদিন লাগবে জানিয়ে মি. খান বলেন, “তারপরে আরও দশ দিন লাগবে শিপমেন্টটা আসতে। ওই শিপমেন্টটা আসলে মোটামুটি তিন সপ্তাহের মধ্যে পাঁচশ এমসিএফডি গ্যাস যুক্ত হবে। তখন কিন্তু আরো বেশি গ্যাস পাবো। বিদ্যুৎ সংকট আরো অনেকটা কমে যাবে।”
ডলার সংকটের কারণে বকেয়া বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এর ফলে দেশের বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়েছে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র।
ডলার সংকটের বিষয়ে মি. খান বলেন, “ডলার আমরা পেমেন্ট করতেছি। আপনারা জানেন যে, ডলারের এভেইলেবিলিটি কিছুটা বেড়েছে। তো এটা কন্টিনিউয়াসলি আমরা মনিটর করতেছি।”