শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
আসিফুর রহমান সাগর:: রোজা শুরুর আগেই মানুষের জীবনধারা পালটে যেতে শুরু করে। মসজিদের শহর ঢাকার পাড়ামহল্লার দৃশ্যপটও বদলে যায়। মসজিদগুলো পরিষ্কার করার পর ঝকঝকে হয়ে ওঠে। পাড়ার দোকানগুলো ইফতারের প্রস্তুতি নিতে দোকানগুলোর বিন্যাস বদলে নেয়।
তবে, ঢাকায় রোজা শুরুর আগে চাঁদ দেখার প্রস্তুতি ঈদের চাঁদ দেখার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। পুরান ঢাকার উঁচু বাড়ির ছাদে উঠে যেত বিকালেই। অনেকেই নৌকা নিয়ে বুড়িগঙ্গার মাঝ নদীতে চলে যেত। চাঁদ দেখার পরপরই কোলাকুলি, মোবারকবাদ জানানোর চল ছিল। উৎসাহীরা পটকা ফোটাত। বন্দুক ও তোপধ্বনি দেওয়া হতো—এতে পুরো শহরের মানুষ জেনে যেত আকাশে পবিত্র রমজানের চাঁদ দেখা গেছে।
ঢাকা গবেষক সাদ উর রহমান ‘ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন ঢাকায় রমজানে সেহরি ও ইফতারে মানুষের নানা অভ্যাস খাদ্য রুচির কথা। তিনি জানান, ১৯ শতক ও ২০ শতকের শুরু দিকে ঢাকায় শবেবরাতের পরেই রমজানের আগমন বার্তার রেশ পাওয়া যেত মানুষের নানান কাজের মাঝে। ঘরদোর পরিষ্কার করা শুরু হতো, খাবার বিক্রির দোকানিরা তাদের ইফতার বানানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করতেন। এখনো এই রীতির খুব একটা বদল ঘটেনি। তিনি জানান, ঢাকার আদি বাসিন্দারা তাদের দীর্ঘ দিনের রুচি ও অভ্যাসের কারণে ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোই ইফতারির খাবার হিসেবে আজো লালন করে চলেছেন।
সেহরির সেকাল একাল : রোজা আসতেই মসজিদে মসজিদে শুরু হয়ে তারাবি নামাজ পড়ার প্রস্তুতি। শুধু ঢাকা নয়, পুরো উপমহাদেশেই মুসলিমদের মধ্যে সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকার চল রয়েছে। এ সময় নামাজ শেষে পুরুষরা গল্পে মেতে থাকেন। পরে সেহরির পর ফজরের নামাজ শেষে সবাই বিছানায় যায়। সেহরির সেকাল, একালে প্রায় একইরকম চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।
পুরান ঢাকার মতো কলকাতা, দিল্লির চাঁদনি চক, লখনৌ, করাচি, লাহোর প্রভৃতি শহরেও ইফতারের সময় থেকে সেহরি পর্যন্ত উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। পরিবারের মানুষরা যেমন দল বেঁধে সেহরি খেতে হোটেলগুলোতে জমায়েত হন তেমনি হোটেল থেকে খাবার কিনে নিয়ে যাওয়ার চলও বেশ। এরসঙ্গে পাড়া-মহল্লায় আয়োজন করা হয় কাওয়ালি গানের আসর। ফলে জমজমাট হয়ে ওঠে সেসব দেশের মুসলিম সম্প্রদায় বসবাসকারী এলাকাগুলো। বাংলাদেশে সেহরিতে বাইরে খাওয়ার বা ঘুরে বেড়ানোর ধারা নতুন শুরু হলেও আশপাশের দেশগুলোর মুসলিম অধ্যুষিত শহর ও এলাকায় এই চল অনেক পুরোনো। সেই ধারাতেই এখন বাংলাদেশেও সেহরির সময়টা ধীরে ধীরে জমজমাট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে হোটেলে সেহরি খাওয়ার চল আগে ছিল না বললেই চলে। গত কয়েক বছর ধরে রমজানে সেহরিকে কেন্দ্র করে মুখরোচক খাবার বিক্রির সংস্কৃতি সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে সেহরি পর্যন্ত খাবারের দোকানগুলোতে মানুষের যে ভিড় জমছে—এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে।
রাজধানীতেও ধীরে ধীরে উপমহাদেশের অন্যান্য শহরের আদলে সেহরি রাত জমজমাট হয়ে উঠছে। দল বেঁধে সেহরি করা রমজানে রাজধানীর মানুষের জীবনে যোগ করেছে এক নতুন অনুষঙ্গ। আর সে কারণে রাত গভীর হলেও রাজধানীর অনেক হোটেলই থাকে মানুষের আনাগোনায় সরগরম।
ভারতের রাজধানী দিল্লির বাসিন্দা সরফরাজ আলম বললেন, কলকাতায়, দিল্লিতে এই পুরো রোজার মাস জুড়ে এক উৎসবের আমেজ শুরু হয়। পাড়ায় পাড়ায় বসে কাওয়ালি গানের আসর। আর মুখরোচক খাবারের দোকানগুলো ইফতারের সময় থেকে জমে ওঠে। পাড়ার সব মানুষ বাইরে বেরিয়ে এসে মিলিত হয়। এইভাবে সেহরি রাত পর্যন্ত চলে। সেহরি শেষে সবাই ঘরে ফেরে।
ব্যস্ত জীবনে যেন বাড়তি আনন্দ নিয়ে হাজির হয় সেহরি উপলক্ষে হোটেলে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করাটা। রাজধানীর অনেক রেস্টুরেন্টই রাতে খোলা থাকে। তবে সবার আগ্রহ থাকে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের দিকেই। পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, চিকেন বিরিয়ানি, খাসির লেগ রোস্ট এবং রেজালার গন্ধে মউ মউ করে ওঠে পুরান ঢাকার অলিগলি। এই মাঝরাতেও পুরান ঢাকার হোটেলগুলোর সামনে প্রাইভেট কারের আনাগোনায় রীতিমতো জ্যাম বেঁধে যায়।
তবে শুধু আনন্দ করবার জন্যই নয়, মানুষকে প্রয়োজনেও বাইরে সেহরি করতে হয়, তাই শহর এলাকার অনেক হোটেলই খোলা থাকে রমজানে। এদিকে, এসব আনন্দ উদযাপনের সময় যাতে ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য বজায় থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখে সেহরি করার পরামর্শ দিয়েছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। তারা বলেন, বন্ধুরা মিলে সেহরি খেতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ধর্মীয় ভাব যেন ক্ষুণ্ণ না হয় সেই বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ইফতারের ঐতিহ্য: রোজাদারের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত ইফতারের সময়। কারণ এ সময় আল্লাহ তাআলা তার রোজাদার বান্দাদের দোয়া কবুল করেন এবং ইফতারের মাধ্যমেই একজন রোজাদার তার রোজা সম্পন্নের পর মহান আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করেন। অঞ্চলভেদে একই দেশে বিভিন্ন রকম ইফতার হয়ে থাকে। তবে ইফতারে কিছু কিছু জিনিস সব জায়গায়ই কমবেশি ব্যবহার হয়। যার মধ্যে খেজুর অন্যতম। কেননা প্রিয় নবী (সা.) এই পবিত্র ফল খেয়ে ও কয়েক ঢোক পানি পান করেই ইফতার শুরু করতেন।
সময়ের পরিবর্তনে ইফতারে যোগ হয়েছে হরেক রকম খাবার। ইফতারে যত কিছু রান্না হয় তা সারা বছর আর কখনোই এক সঙ্গে এত রান্না করার চল নেই বাঙালি মুসলমানের। পুরুষরা বাইরে কাজে থাকে আর জোহর নামাজের পর মহিলারা রান্নার কাজ শুরু করেন। বাজার থেকে আসে শিক কাবাব, মুরগির হান্ডি কাবাব, জিলাপি, বুন্দিয়া, নিমকপাড়া। আর বাসায় বানানো হতো পিঁয়াজু, বেগুনি, ফুলুরি। মুড়ির সঙ্গে পিঁয়াজু, ঘুগনি, ফুলুরি দিয়ে পেঁয়াজ মরিচের কুচি দিয়ে মাখানোও এখন বাঙালি মুসলিম সমাজে ইফতারের প্রধান খাবার হয়ে উঠেছে। এদিকে, পুরান ঢাকার চক বাজারে গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী ইফতারের বাজার। সেখানে ইফতারে নানা আয়োজন নিয়ে জোহরের পর থেকেই দোকানিদের পসরা সাজানো শুরু হয়ে যায়। পুরান ঢাকায় বাসায় যেটুকুই ইফতার আয়োজন করা হোক না কেন তার একটি অংশ মসজিদের পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। যারা প্রতিদিন পাঠাতে পারতেন না তারা বৃহস্পতি ও শুক্রবার পাঠাতেন। রোজাদার পথিক, গরিব মানুষদের ইফতারের ব্যবস্থা থাকত মসজিদগুলোতে। এতে করে রোজাদার পথিক ও বিভিন্ন কারণে ঢাকায় উপস্থিত মুসল্লিদের এক সঙ্গে ইফতার করার এক ভ্রাতৃত্ব ও নৈকট্যের সৃষ্টি হতো।
রমজানে ইফতারের আজান শোনার পর সর্বপ্রথম জমজমের পানি শরবতে মিশিয়ে পান করা হয় পুরান ঢাকায়। এরপর কাটা খোরমা বা খেজুর দুই এক টুকরো খাওয়া হতো এবং একে সওয়াবের কাজ মনে করেই খাওয়া হতো। ঢাকায় শরবত অনেকভাবে তৈরি করা হতো। তার মধ্যে তোকমার শরবত, বেলের শরবত, লেবুর শরবত, তেঁতুল গুড়ের শরবত, বেদানার শরবত, মিশ্রি শরবতে পেস্তা বাদাম সহযোগে ইফতারে পান করা হতো। ইফতারে লোকেরা ফালুদা বেশি পছন্দ করত কেননা এটা এই এলাকায় খুব ভালোভাবে তৈরি হতো। পুরান ঢাকাবাসী আজও এই ঐতিহ্য অনেকটাই ধরে রেখেছে।
বাংলাদেশের প্রচলিত ইফতারে খেজুর, পিঁয়াজু, বেগুনি, হালিম, আলুর চপ, জিলাপি, মুড়ি ও ছোলা খুবই সাধারণ আইটেম। একটু ব্যতিক্রমী হলে থাকে সমুচা, ফিশ কাবাব, মাংসের কিমা ও মসলা দিয়ে তৈরি কাবাবের সঙ্গে পরোটা, মিষ্টি ও ফল। শরবতসহ এসব খাবার এ দেশের ইফতার টেবিলকে দেয় পরিপূর্ণ রূপ। কিছু অঞ্চলের ইফতারের আসরে খিচুড়ি, চিড়া ইত্যাদিও শোভা পায়। বছরের অন্য সময় দইবড়া কোনো দোকানেই কিনতে পাওয়া না গেলেও ইফতারের আইটেম হিসেবে বাঙালি মুসলমানের কাছে এটি খুব জনপ্রিয়। ইত্তেফাক