ঢাকা: বিএনপির ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১ সেপ্টেম্বর বের হওয়া র্যালিতে বাধা দেয়াকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সাথে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন নেতাকর্মীদের ভয়াবহ সংঘর্ষে বন্দরনগরী রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিএনপি নেতাকর্মীদের ইটপাটকেলের জবাবে পুলিশ টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও গুলি চালিয়েছে। সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন যুবদল নেতা রাজ আহমেদ শাওন। আরো একজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে তার নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। এ ছাড়া অনেক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন দুই শতাধিক নেতাকমী। সংঘর্ষের সময় প্রায় ৪ ঘণ্টা অচল হয়ে পড়ে নারায়ণগঞ্জ।
বিএনপি নেতারা দাবি করেছেন, পুলিশের গুলিতে মারা গেছে যুবদল নেতা শাওন। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শাওন ফতুল্লার বক্তাবলী ইউনিয়নের গোপালনগর এলাকার শাহেদ আলীর ছেলে। সংঘর্ষে প্রায় ১৪-১৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। ২নং রেলগেট এলাকায় একটি স্কুল মাঠে পুলিশের টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় ৩০ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়েছে।
গুলি ও সংঘর্ষে আহতরা হলেন, জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবি, সোনারগাঁও থানা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নান, সস্তাপুর এলাকার হাজী মহব্বতের ছেলে যুবদল নেতা শাহিন (৪০), শহরের টানবাজার এলাকার মহিবুলের ছেলে জাহাঙ্গীর (৩০), টানবাজারের ফারুকের ছেলে রাজু (২৬), সোনারগাঁওয়ের খেদমত আলীর ছেলে শরীফ (২৫), ফতুল্লার কবিরের ছেলে ইউনুস (৪৩), সিদ্ধিরগঞ্জের মতিউর রহমানের ছেলে সাগর (২২), জিমখানার আব্দুল জব্বারের ছেলে আব্দুস সালাম (৬০), মিজমিজির মো: হাফিজ মিয়ার ছেলে মো: আখতার (৫২), দেওভোগ মিলন শেখের ছেলে স্বর্ণ শিল্পী মুন্না (১৮), দেওভোগ দাতা সড়কের শহীদ মিয়ার ছেলে মো: কাদির (২৭), ২নং রেলগেট আলমাছ পয়েন্টের মো: ইসহাকের ছেলে মো: শরীফুল ইসলাম (১৯), শহীদনগরের মো: জামালের স্ত্রী শাহনাজ (৫০), হোসাইনীনগরের হানিফ গাজীর ছেলে মো: সবুজ (৩৪), দেওভোগ পানির টাঙ্কির নূর মোহাম্মদের ছেলে মোমেন (৫৫), ২নং রেলগেটের মোজাম্মেল হকের ছেলে শিহাব (২৫), পাইকপাড়ার মৃত সুরুজ মিয়ার ছেলে শামসুল হক (৫০), বেপারীপাড়ার শাহজাহানের স্ত্রী শিল্পী (৪০), জামাইপাড়া এলাকার মো: মিলনের ছেলে মো: ইব্রাহিম (২৫), ২নং রেলগেট এলাকার কামাল হোসেনের ছেলে সিদ্ধিরগঞ্জের মুক্তি গার্মেন্টের শ্রমিক তাজুল ইসলাম (৩০), মাসদাইরের আবুল কালামের ছেলে আশরাফুল (৩২), শহরের করিম মার্কেটের ইউএস হোসিয়ারির শ্রমিক সোয়াদ হোসেন (৩০), উজ্জ্বল ভৌমিক (২৮), মিন্টু (২৮), সজিব (১৮), বন্দর রূপালী এলাকার মো: হাসেমের ছেলে মো: নাসির (৪০)
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সকালে নারায়ণগঞ্জ শহরের ২নং রেলগেট এলাকা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর র্যালি বের করলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ পাল্টা রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও গুলি ছোড়ে। এতে পুলিশ, সাংবাদিক, বিএনপি, ছাত্রদল যুবদলের বহু নেতা কর্মী আহত হন। এ সময় নগরীর ডিআইটি, মণ্ডলপাড়া, দেওভোগ, নিতাইগঞ্জ, ২নং রেলগেট এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুরো নগরীর মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ওই সব এলাকার রাস্তাঘাট লোকশূন্য হয়ে যায়। সংঘর্ষ চলে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবি বলেন, আমিসহ দলের দুই শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। পুলিশ গুলি ছুড়েছে। আমি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছি। যুবদলের শাওন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আরো একজন মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি, তবে তার নাম পাইনি। অনেক নেতাকর্মী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তিনি আরো বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শহরের চুনকা পাঠাগার থেকে আমরা মিছিল নিয়ে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এ সময় পুলিশ বাধা দেয়। পরে সেখান থেকে চলে আসার সময়ে শহরের ২নং রেলগেটের কাছে এলে পুলিশ ফের বাধা দেয় ও লাঠিচার্জ করে। পরে তারা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে এবং টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে।
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির সদস্যসচিব অধ্যাপক মামুন মাহমুদ বলেন, সংঘর্ষে দুই শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে শতাধিক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব মশিউর রহমান রনি জানান, নিহত শাওন যুবদলের একজন নেতা। এখনো যুবদলের কমিটি হয়নি, কমিটি হলে ভালো পদ পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। সে আমাদের সাথে দীর্ঘদিন রাজনীতি করে আসছে।
তিনি আরো দাবি করেন, সকালে ২নং রেলগেট এলাকায় মিছিল নিয়ে বের হওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে শাওন আহত হন। তার বুকে গুলি লেগেছে। পরে তাকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা: এস কে ফরহাদ বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শাওনকে হাসপাতালে আনা হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তার শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বেলা ২টায় শহরের ২নং রেলগেট পুলিশ বক্সের সামনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, কেউ নিহত হওয়ার সংবাদ পুলিশের কাছে নেই। পুলিশের প্রায় ১৪ জন আহত হয়েছেন। তাদের চিকিৎসা দিতে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, নারায়ণগঞ্জ বিএনপি নেতাকর্মীরা কোনো রকম অনুমতি ছাড়া মিছিল বের করে, যাতে মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। তাদের বারবার অনুরোধ করা হলেও রাস্তা থেকে সরেনি। উল্টো পুলিশের ওপর হামলা করেছে। পুলিশ জনগণের জানমাল নিরাপত্তায় আইনত ব্যবস্থা নিয়ে তাদের প্রতিহত করেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে আগে কোনো ধরনের বাধা দেয়া হয়নি।
তিনি জানান, পূর্বানুমতি ছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীরা সড়ক অবরোধ করেন। পুলিশ তাদের সরাতে চাইলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পরে জানমাল রক্ষার্থে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও শর্টগানের গুলি ছোড়ে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: আমীর খসরু বলেন, এই সংঘর্ষে পুলিশের ১৫-২০ জন আহত হয়েছেন। তবে বিএনপির কতজন আহত বা নিহত হয়েছেন তা নিশ্চিত না। একজন নিহত হয়েছে বলে শুনেছি, তদন্ত করে বলতে পারব।
মিছিলের অগ্রভাগে ছিল শাওন : র্যালিতে অংশ নিতে জেলা যুবদলের নেতা সাদেকুর রহমানের নেতৃত্বে একটি মিছিল শহরের ২নং রেলগেট এলাকায় গিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে জড়ো হয়। ওই মিছিলের সামনের সারিতে উপস্থিত ছিলেন যুবদল নেতা রাজা আহমেদ শাওন। কিন্তু কে জানত এটাই তার শেষ মিছিল। শেষ সেøাগান। বিএনপির জেলা ও মহানগর নেতাদের নেতৃত্বে র্যালি শুরু করার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ ও ডিবি বাধা দেয়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পুলিশ বিএনপি নেতাদের ব্যানার কেড়ে নেয় এবং লাঠিচার্জ করে।
পরে ছত্রভঙ্গ হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশের সাথে সংঘাতে জড়ায়। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে, প্রতিউত্তরে পুলিশ মুহুর্মুহু শর্টগানের গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় মণ্ডলপাড়া থেকে ২ নম্বর গেট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সড়ক। এ সময় পুলিশের শর্টগানের গুলিতে মারা যান আহমেদ শাওন।
টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় ৩০ শিক্ষার্থী অসুস্থ : নারায়ণগঞ্জ শহরে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে স্কুল মাঠে টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় ৩০ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। আহতরা নারায়ণগঞ্জ মর্গ্যান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। বেলা ১১টার দিকে স্কুল প্রাঙ্গণে এই ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষ চলাকালে একটি টিয়ার শেল স্কুল মাঠে এসে পড়ে। টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় অচেতন হয়ে পড়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মর্গ্যান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ অভিযোগ করেন, ঘটনার পর পুলিশের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও পুলিশ ফোন কল রিসিভ করেনি। বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ স্কুল মাঠে একটি টিয়ার শেল এসে পড়ে। এতে মাঠে খেলতে থাকা আমাদের প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঘটনার পরপরই আমরা পুলিশ সুপারকে ফোন দেই। কিন্তু তিনি আমাদের ফোন কল রিসিভ করেননি। পরে অসুস্থদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।
নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী উম্মেহানীকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। তীব্র শ্বাসকষ্টে ছটফট করছে সে। তার মা ও হাসপাতালের নার্সরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। পরে দ্রুত তাকে ইমার্জেন্সি রুম থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। একইভাবে দশম শ্রেণীর ছাত্রী আয়েশাকেও রাখা হয়েছে অক্সিজেন সাপোর্টে। সে অচেতন ছিল দীর্ঘসময়। জ্ঞান ফিরে আসার পর কিছুটা উন্নতি হয়েছে তার।
আয়েশার মা বলেন, স্কুলের মাঠে আমার মেয়ে খেলছিল, হঠাৎ টিয়ার শেল এসে পড়লে আমার মেয়েসহ আরো অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে যায়। কেউ কেউ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে শিক্ষকরাই তাদের হাসপাতালে এনে আমাদের ফোন দেন। এসে দেখি মেয়ের এই অবস্থা।ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নাজমুল হোসেন বলেন, আমাদের হাসপাতালে বেশ কিছু স্কুল শিক্ষার্থী টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছে। তাদের অক্সিজেন সেবার পাশাপাশি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
যুবদলের আটজন গুলিবিদ্ধ ঢামেকে ভর্তি : ঘটনায় গুলিবিদ্ধ আট যুবদলকর্মী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে (ঢামেক) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চিকিৎসাধীন আছেন মো: বাদল ভূঁইয়া (৩৫), নাবির হোসেন নবীন (৩০), মো: রাসেল প্রধান (৩০), মো: জুয়েল আরমান (৪০), মো: ফারুক হোসেন (৩০), মো: আকিব (২২), মো: সুলতান মাহমুদ (২৫) ও মো: আলিব (২৫)।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো: বাচ্চু মিয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেন জানান, নারায়ণগঞ্জ থেকে যুবদলের আটজন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যালে এসেছেন। জরুরি বিভাগে তাদের চিকিৎসা চলছে। নয়া দিগন্ত