ঢাকা: ঈদের আগের দিন তেলেসমাতি দেখায় সয়াবিন। হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায় বাজার থেকে। কারা এই কাণ্ডে জড়িত আর তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে এ নিয়ে চলছিল নানা আলোচনা। এরই মধ্যে গতকাল দিনের শেষ দিকে এসে বড় খবর দিলো বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার পর মিল মালিকদের ওই সংগঠন জানায়, বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করা হয়েছে। ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা। খোলা সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি লিটার ১৮০ টাকা, যা এতদিন ১৪০ টাকা ছিল। নতুন মূল্য তালিকা অনুযায়ী, পরিশোধিত পাম সুপার তেল প্রতি লিটারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হবে ১৭২ টাকা, যা এতদিন ছিল ১৩০ টাকা।
এর আগেও কয়েক দফায় সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। উচ্চ মূল্যের কারণে অনেকে সয়াবিন তেলের ব্যবহারও কমিয়ে দেন। খুবই অল্প পরিমাণ সয়াবিন তেল কেনার ছবিও ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে
গত ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্য তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৭ টাকা ও খোলা সয়াবিন তেল ১৪৩ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে মিল মালিকরা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে মন্ত্রণালয়ে গেলেও সরকার সায় দেয়নি। মার্চের মাঝামাঝিতে তেলের আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রয় পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের পর লিটারে ৭ টাকা করে দাম কমানো হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে এপ্রিল ও মে মাসে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিতে থাকেন মিল মালিকরা। ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতারাও তেলের মজুত শুরু করেন। এসব ঘটনা ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে ধরা পড়ে।
ঈদের আগে তেলেসমাতি
ঈদের আগের দিন বাজারে ভোজ্য তেল কিনতে গিয়েছিলেন রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান। বাজারে গিয়ে দেখেন কোনো দোকানেই তেল নেই। শুধু একটি দোকানে একটি মাত্র কোম্পানির তেল পান। কিন্তু দাম চাওয়া হয় ২২০ টাকা লিটার। এত দাম কেন- জিজ্ঞেস করলে দোকানদার জানান ‘এমনিতেই তেল নেই, এই দামে নিলে নেন না নিলে চলে যান।’ পরে বাধ্য হয়ে ২২০ টাকায় এক লিটার তেল কিনেন তিনি। ঈদের বিভিন্ন রান্না-বান্নায় তেল শেষ হয়ে যাওয়ায় গতকাল আবার বাজারে আসেন তেল কিনতে। কিন্তু কয়েকটি দোকান ঘুরেও তেল পাননি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি দোকানে এক লিটারের বোতল পান। কিন্তু দাম নেয়া হচ্ছে ২২০ টাকা। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত দামেই এক লিটার তেল কিনেছেন সিদ্দিকুর রহমান। তিনি জানান, শুধু বসুন্ধরা ও তীর কোম্পানির অল্প কিছু তেল দুই একটি দোকানে পাওয়া যাচ্ছে। তবে দাম বেশি হওয়ায় সবাই এক লিটার করে কিনছেন। ঈদের আগেও এই পরিস্থিতি ছিল। ভেবেছিলাম ঈদের পর কমবে। কিন্তু এখনো দেখছি বাজারে তেল নেই।
শুধু মিরপুর নয়, ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারা দেশেই তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত দাম নেয়া হয়। ঈদের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই অসাধু ব্যবসায়ীদের এই কারসাজি শুরু হয়। তবে ঈদের পরেও থেমে নেই তারা। এখনো সিন্ডিকেট করে ভোক্তাদের পকেট কাটছেন অসাধুরা। অথচ রমজান মাসে তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৬০ টাকা বেঁধে দিয়েছিল সরকার। তবে এ দামে মিল মালিকরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বাজারে সংকট তৈরি করা হয়েছে। বেশির ভাগ কোম্পানিগুলো কোনো তেলই সরবরাহ করেনি। এই সুযোগে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের ফাঁদে ফেলে তেলের অতিরিক্ত দাম নিচ্ছেন।
সরজমিন রাজধানীর কয়েকটি দোকানে গিয়ে দেখা যায়, দোকানে অনেক ক্রেতারাই ভিড় করছেন তেলের জন্য। কৌশলে প্রথমে দোকানদার তেল নেই বললেও পরবর্তীতে জিজ্ঞেস করেন কয় লিটার লাগবে? অল্প কিছু তেল আছে, দাম পড়বে ২২০ টাকা লিটার। যারা এই দামে নিতে রাজি হচ্ছেন তাদেরকেই শুধু দোকানে লুকিয়ে রাখা তেল বের করে বিক্রি করছেন।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা যায়, তেলের সরবরাহ নেই বললেই চলে। কিছু দোকানে আগের কিছু তেল রয়েছে। তবে বোতলের গায়ে দেয়া মূল্য ঘষে তুলে ফেলে দাম নেয়া হচ্ছে ২২০ টাকা লিটার। রাজধানীর ইব্রাহিমপুর বাজারের তেল বিক্রেতারা জানান, রোজার শুরু থেকেই চাহিদা অনুযায়ী সয়াবিন তেল পাচ্ছেন না তারা। পাঁচ লিটার তেলের বোতল পাওয়া যায় না। এক ও দুই লিটার অল্প পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। ঈদের আগেই তেল শেষ হয়ে গেছে। কোনো কোম্পানি তেল দিচ্ছে না। অর্ডার করলে ডিলাররা দেয় না। আগের কিছু ছিল সেগুলোই বিক্রি করছি। তবে দাম বেশি কেন জিজ্ঞেস করলে তারা সদুত্তর দিতে পারেননি কেউ।
তবে এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, সরকারের নির্ধারিত দামেই আমরা চাহিদা অনুযায়ী মিল থেকে ভোজ্য তেল সরবরাহ করছি। কোনো সংকট নেই। বিশ্ব বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে। তাই আমাদের এখানেও বাড়বে এমন ভাবনায় ডিলার ও খুচরা দোকানিরা তেল বিক্রি না করে মজুত করছেন। পরে বেশি দামে বিক্রি করবেন এই আশায় আছেন তারা। এজন্যই তারা তেলের সরবরাহের সংকট আছে বলে অজুহাত দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক থাকলে তেলের এ সংকট দেখা দিতো না। প্রতিটি মার্কেটে ডিস্ট্রিবিউটর দিয়ে রেখেছে, তারা কি চাহিদা অনুযায়ী তেল পেয়েছে? তাহলে কীভাবে তারা দাবি করছে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক আছে? মিলগুলো অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেরা ভালো থাকতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, তেলের মূল সমস্যা হলো, সরকার রমজান মাসে ১৬০ টাকা লিটার দাম বেঁধে দিয়েছিল। এ দামে মিল মালিকরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারা আরও বেশি দামে তেল বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার রোজায় তা করতে দেয়নি। তাই তারা সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বাজারে সংকট তৈরি করেছে। এখন বিভিন্ন পক্ষের ওপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। সরকার যদি ওই সময় তেলের দাম বাড়িয়ে দিতো তাহলে দাম বেশি হলেও এই সংকট তৈরি হতো না।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, পাইকারি বাজারে বেশির ভাগ ভোজ্য তেল বাল্ক আকারে বিক্রি হয়। কিন্তু অধিকাংশ মিল বাল্কে তেল বিক্রি করেনি। ঢাকায় বাল্কে তেল বিক্রি করেছে তিনটি মিল। এর মধ্যে সিটি, মেঘনা, টি কে গ্রুপ আর চট্টগ্রামে সাপ্লাই দিয়েছে এস আলম আর সিটি গ্রুপ। অন্য যেসব ভোজ্য তেলের প্রতিষ্ঠান আছে যেমন, রূপচাঁদা ও বসুন্ধরাসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, তারা তেল সরবরাহ করেনি। আর যারা দিয়েছে তারা সর্বনিম্ন সরবরাহ করেছে। এ কারণে বাজারে তেলের সংকট হয়েছে। মিলেও তেলের কোনো সংকট নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, মিলগু?লো সরবরাহ ঠিক রাখলেও ডিলার, পাইকার ও খুচরা দোকা?নিরা চাহিদা অনুযায়ী তেল বিক্রি করছেন না। তারা মজুত করে বাজা?রে সংকট সৃষ্টি করছেন। মানব জমিন